“মাদক” শব্দটির সাথেই যেন জড়িয়ে আছে একধরনের ভীতি, আতংক আর অনিশ্চয়তার
প্রতিচ্ছবি। এটি এমন একটি নেশা জাতীয় দ্রব্য যা যেকোন বয়সের মানুষকে তার
কৌতুহলের ক্ষেত্র বা নৈরাশ্যজনক পরিস্থিতি মোকাবেলায় অক্ষম হলে তাকে আকর্ষিত করে।
নেশা একজন মানুষকে আলোর পথ থেকে ক্রমশই অন্ধকারের দিকে নিয়ে যায়। সে দেশ,
জাতি, সমাজ ও পরিবারের উপর কেবল বোঝা হিসাবেই দিনপাত করতে থাকে। একজন
মেধাবী ছাত্র বা ছাত্রী, একজন সুদক্ষ পেশাজীবি ব্যক্তি, একজন সৃজনশীল ব্যক্তি অথবা
বয়সন্ধিকালে প্রবেশ করা কোন বালক বা বালিকা মাদকের নেশায় নিজের জীবনকে বিপন্ন
করে তুলতে পারে।

এই সকল অনাকাংখিত কর্মকান্ড গুলি প্রতিরোধে সমাজ বা রাষ্ট্রের বা পরিবারের বিভিন্ন
সদস্যদের গুরুত্বপূর্ন ভূমিকা রয়েছে। এর মধ্যে বাবা মায়ের কিছু করনীয় বিষয়বস্তু নিয়ে
আজকে আলোচনা করব।

১। একটি সন্তান তার বাল্যকালের সকল কর্মকান্ড পরিচালনার পর বয়ঃসন্ধিকালে পৌছাঁয়।
এই বয়সটা ১২ বছর থেকেই সাধারনত শুরু হয় এবং এই সময়কার দৈহিক ও মানসিক
পরিবর্তনগুলি ১৬ বছর বয়স পর্যন্ত চলতে থাকে। এই সময় ছেলে মেয়েরা তাদের দৈহিক
পরিবর্তনগুলিকে গ্রহন করা বা তাদের পরিবর্তীত দৈহিক পরিবর্তনের সাথে সামঞ্জস্য বিধান
করার ক্ষেত্রে একটু হতাশাব্যঞ্জক আচরণ, খিটখিটে মেজাজ, একাকীত্ব প্রিয়, লজ্জা প্রবন,
গোপনীয়তা রক্ষার প্রবনতা ইত্যাদি নানা ধরনের আচরণ করে থাকে। তাই বাবা মায়েদের
সন্তানের এই বয়সটাকে অতি গুরুত্বের সাথে বিবেচনা করতে হবে। সন্তানদের সাথে
বন্ধুত্বসুলভ আচরণ করতে হবে যেন তারা বাবা মাকে তাদের সব ধরনের সমস্যাগুলি ব্যক্ত
করতে পারে।

২। একমাত্র বাবা মাই পারে তার সন্তানের চলমান শুন্যতাকে উপলব্ধি করতে। একটি ছেলে
বা মেয়ে যখন কোনো একটা দন্দ্ব বা হতাশার মুখোমুখি হয় তখন সে তার এই কষ্ট কারো
কাছে বলে নিজেকে হালকা করতে চায়। আর সেজন্য ছেলে বা মেয়েটি একটা নিরাপদ

আশ্রয় অর্থাৎ এমন একজনকে খোঁজে যে তার এই কষ্টে সহমর্মী হতে পারবে। বাবা মা হলো
প্রথম আশ্রয়স্থল যেখানে ব্যক্তি তার সব কিছু শেয়ার করতে পারে। তাই বাবা মাকে
সন্তানের সাথে সেই সম্পর্ক বজায় রেখে চলতে হবে, যেন বন্ধুত্ব সুলভ সম্পর্কের মধ্যে শাসন
থাকে কিন্তু সেই শাসনে বাস্তব দৃষ্টিভঙ্গি ও কাঙ্খিত আচরণের প্রতি ইঙ্গিত থাকে। তাহলেই
পরিবারকে সন্তানটি তার আশাহীন অবস্থা দূরীকরণের একটা শক্ত প্লাটফর্ম ভাববে। মাদক বা
অন্য কোন নেশায় আকর্ষিত হবে না।

৩। বর্তমানে মাদকাসক্তি একটি মহামারি আকার ধারণ করেছে। শুধু বাংলাদেশ নয়, সারা
বিশ্বে এই নেশা ও নেশার কারণে সমাজে নানা ধরনের অপরাধমূলক আচরণ ও কর্মকান্ড
সংঘটিত হচ্ছে। মাদকের অধিক সরবরাহ এবং অতি সহজ প্রাপ্য হওয়ায় কিশোর, যুবক বা
মধ্য বয়সের যেকোন মানুষের কাছে এটি এখন একটি কৌতুহল বা দুঃখ ভোলার মাধ্যম
হিসাবে গৃহিত হচ্ছে। একমাত্র বাবা মায়ের সচেতনতামূলক দৃষ্টি এবং সন্তানকে সঠিকভাবে
সময় দেয়া ও তাদের সামাজিক কর্মকান্ডগুলির দিকে খেয়াল রাখাই পারে এই সমস্যা থেকে
মুক্তিদান করতে।

৪। বিভিন্ন ধরনের মাদকদ্রব্য বা নেশার উপকরণ আছে। প্রতিটি মাদকদ্রব্যের একেকটির
আলাদা বৈশিষ্ট্য থাকে। তাই এগুলো গ্রহণের পর একেক মাদকদ্রব্যেও একেক ধরনের লক্ষন
প্রকাশ পায়। কোনটি শরীর ও মস্তিষ্ককে নিস্তেজ করে, কোনটি অধিক মাত্রায় উত্তেজিত
করে। বর্তমানে বিভিন্ন গণমাধ্যমে এই ধরনের মাদকদ্রব্য সম্পর্কে বিভিন্ন তথ্য বহুল অনুষ্ঠান
বা আর্টিকেল প্রকাশ করা হয়। বাবা মায়েরা যদি এইরূপ তথ্যগুলি গুরুত্ব সহকারে বিশ্লেষন
করেন এবং সন্তানের হঠাৎ পরিবর্তনশীল আচরণ বা দীর্ঘদিন শরীরের নানা পরিবর্তন যা
নেশায় আসক্ত হওয়ার ফলে ঘটে থাকে সেগুলো সম্পর্কে অবহিত থাকেন তবে সন্তানকে সুপথে
পরিচালনা সহজতর হবে।

৫। প্রতিটি বাবা মাকে নিজেদের রাগ নিয়ন্ত্রন করে সন্তানের অনাকাংখিত আচরণকে শুধরে
দেয়ার প্রবনতা তৈরী করতে হবে। কিশোর বয়সের কোন সন্তান অযাচিত কিছু কেনার
আবদার করলে ঐ মুহুর্তে তাকে বকাঝকা না করে ধীরে সুস্থ্যে বোঝাতে হবে। আর যদি
সন্তানটি অতি মাত্রায় রাগান্বিত হয়ে যায় তবে তাকে স্বাভাবিক হওয়া পর্যন্ত সময় দিতে
হবে। মাথা ঠান্ডা হলে বা সে যখন রাগান্বিত অবস্থা থেকে বের হয়ে আসবে তখন তাকে
বুঝিয়ে বললে হয়ত সে বুঝতে পারবে।

৬। যৌবন বয়সে বা যুবক-যুবতী অবস্থায়ও নানা ধরনের জটিলতা ব্যক্তির মধ্যে দেখতে
পাওয়া যায়। যেমন প্রেমে ব্যর্থতা, চাকুরীর অনিশ্চয়তা, বিবাহ বিষয়ক জটিলতা,

ভাইবোনের মধ্যে তিক্ত সম্পর্ক, চাকুরী ক্ষেত্রে সমস্যা ইত্যাদি আরো অনেক সমস্যা ব্যক্তির
জীবনকে হতাশাব্যঞ্জক করে তোলে। অনেক সময় ব্যক্তি বিষন্নতায় ভূগতে শুরু করে। এরূপ
হতাশা বা বিষন্নতার কারনে অনেক সময় মাদকদ্রব্য সেবনের প্রতি সে আকর্ষিত হয়ে পড়ে।
বাবা মা এরূপ পরিস্থিতিতে সন্তানের সকল সমস্যার বা কষ্টের সমাধানের একটি গুরুত্বপূর্ন
মাধ্যম হিসাবে কাজ করতে পারেন। জীবনটাকে উপভোগ করার জন্য শুধু যে মসৃন পথেই
হাটতে হবে এটা যে সত্য নয় বরং অমসৃন ও বেদনাদায়ক পথেও হাটতে হবে এবং মনোবল
দিয়ে তা অতিক্রম করতে হবে সেটাও সন্তানকে বোঝানোর প্রথম ভূমিকাটাই পালন করতে
পারেন বাবা মা।

৭। সবশেষে বলা বাহুল্য যে সন্তানকে কিশোর বয়স থেকেই পড়ালেখার পাশাপাশি নানা
ধরনের সৃজনশীল কর্মকান্ডে নিয়োজিত রাখা যেমন সাংস্কৃতিক কর্মকান্ড, খেলাধুলা ইত্যাদিতে
সম্পৃক্ত করলে সন্তানটি সামাজিকতার মাপকাঠিতে একজন সুনাগরিক এবং সুসন্তান হিসাবে
গড়ে উঠতে পারে। বাবা-মা-ই একমাত্র সন্তানকে এসব বিষয়গুলিতে সম্পৃক্ত করে এবং
সন্তানটি কোন ধরনের বন্ধুদের সাথে মেলামেশা করছে বা কোথায় যাচ্ছে এসব সুদক্ষভাবে
নজরদারি করে সন্তানকে নেশায় আসক্ত হওয়া থেকে রক্ষা করতে পারেন।

তাই সন্তানকে নেশার কালো হাতছানি থেকে রক্ষা করার জন্য বাবা-মায়ের

প্রতি আহবান হবে “শাসক নয় সচেতন বন্ধু হিসাবে সন্তানের প্রতিপালন করুন।”

Psycure

Scroll to Top