শান্তশিষ্ট স্বভাবের সারার আজকের দিনটা অন্যান্য দিনের চেয়ে অস্থিরতায় কাটছে৷ কোনো কিছুই তার ভালো লাগছে না, কোনো কিছুতেই সে শান্তি পাচ্ছে না, কাজে মন বসাতেই পারছে না। আশপাশের কাউকেই সারার সহ্য হচ্ছে না, বিরক্তবোধ করছে, অসহ্য লাগছে সব। কোনোভাবেই নিজের মনকে নিয়ন্ত্রণে রাখতে পারছে না। হঠাৎ করে সারা খেয়াল করল তার বুক ধড়ফড় করছে, গলা শুকিয়ে আসছে, স্থির হয়ে কোথাও বসতে পারছে না। মাথাও কাজ করছে না। চিন্তাভাবনা সব গুলিয়ে যাচ্ছে।
সারার মতো আপনিও বোধহয় মাঝে মধ্যে এমন সমস্যার সম্মুখীন হয়ে থাকেন। কিন্তু এটাকে কী বলে? প্যানিক অ্যাটাক না অ্যাংজাইটি অ্যাটাক?
প্যানিক অ্যাটাক কী?
প্যানিক অ্যাটাক একধরনের মানসিক সমস্যা। হঠাৎ করে অতিরিক্ত দুশ্চিন্তা, ভয় বা আতঙ্কে শারীরিক কোনো প্রতিক্রিয়া ঘটলে বা উপসর্গ প্রকাশ পেলে তাকে প্যানিক অ্যাটাক বলা হয়।
যেকোনো সময় যেকোনো স্থানে প্যানিক অ্যাটাক হতে পারে। এর পেছনে কোনো যুক্তিসংগত কারণও থাকে না। যেকোনো বিষয়কে কেন্দ্র করে প্রবল ভয়ভীতিতে আচ্ছন্ন হলে প্যানিক অ্যাটাক হতে পারে।
যুক্তরাষ্ট্রের প্যাসিফিক নিউরোসায়েন্স ইনস্টিটিউটের সাইকিয়াট্রিস্ট ডেভিড এ. মেরিল বলেন, “অনেকের একবার প্যানিক অ্যাটাক হলে পরবর্তীতে আর হয় না। অন্যদের বারবার প্যানিক অ্যাটাক হতে পারে।” আমেরিকার একটি গবেষণায় দেখা গেছে, প্রাপ্তবয়স্কদের মধ্যে প্রতিবছর প্রতি ৯ জনের মধ্যে একজনকে প্যানিক অ্যাটাকে আক্রান্ত পাওয়া যায়। প্রাপ্তবয়স্কদের মধ্যে যাঁদের বয়স কম, তাঁদের মধ্যেই এটি বেশি দেখা যায়। ছেলেদের চেয়ে মেয়েদের মধ্যে এটি প্রায় দ্বিগুণ বেশি।
অ্যাংজাইটি অ্যাটাক কী?
অ্যাংজাইটি মানেই হলো ভবিষ্যতের ভয়। আমরা সবসময়ই ভবিষ্যতের কথা চিন্তা করে নিজেরাই স্ট্রেস সৃষ্টি করি। অ্যাংজাইটি অ্যাটাক হলে শরীরে স্ট্রেসের মাত্রা বাড়ে। এর ফলে রক্তে স্ট্রেস হরমোনের ক্ষরণ বাড়ে। ভয় পেলেই মস্তিষ্কের রক্তে আপদকালীন হরমোন বা অ্যাড্রিনালিন বেশি পরিমাণে মেশে। সিম্প্যাথেটিক নার্ভাস সিস্টেমই এই অবস্থার জন্য দায়ী।
প্যানিক অ্যাটাকের লক্ষণ
অ্যানজাইটি অ্যান্ড ডিপ্রেশন অ্যাসোসিয়েশন অব আমেরিকার মতে, প্যানিক অ্যাটাকের উল্লেখযোগ্য উপসর্গ হলো:
- বুক ধড়ফড় করা, হৃদপিণ্ডের গতি বেড়ে যাওয়া, মনে হতে পারে হৃদপিণ্ড বুকের মধ্যে লাফাচ্ছে
- অনেক বেশি ঘামতে থাকা এবং শরীর কাঁপা, বিশেষ করে হাত ঘেমে যাওয়া
- শ্বাসকষ্ট বা শ্বাসরোধ হচ্ছে মনে হওয়া
- দম বন্ধ হয়ে আসা বা মনে হওয়া কেউ গলা চেপে ধরেছে
- বমিভাব
- পেট কামড়ানো
- মাথা ঘোরানো বা চেতনা হারাচ্ছে মনে হওয়া অসাড়তা বা শরীর ঝিনঝিন করা
- ঠান্ডা বা গরম লাগা
- আশপাশের সবকিছুকে অবাস্তব মনে হওয়া মানসিক অবস্থাকে নিয়ন্ত্রণ করতে না পারা
- মৃত্যুভয় ব্যক্তিকে হঠাৎ করেই যেন গ্রাস করে ফেলে
- বারবার দুঃস্বপ্ন দেখা
- আক্রান্ত ব্যক্তি যেসব স্থানে বিপদ হলে সাহায্য পাওয়া বা মুক্তি পাওয়া কঠিন মনে করেন, সেসব স্থানে গেলে বা যাওয়ার কথা ভাবলে প্রচণ্ড উদ্বেগ অনুভব করেন।
প্রতিটি অ্যাটাক সাধারণত ২০ থেকে ৬০ মিনিটের বেশি দীর্ঘস্থায়ী হয় না। এসব উপসর্গের মধ্যে চারটি বা ততোধিক উপসর্গে ভুগলে ধরে নিতে পারেন যে প্যানিক অ্যাটাক হচ্ছে। তবে এর চেয়ে কম উপসর্গ নিয়েও প্যানিক অ্যাটাক হতে পারে। ইউনিভার্সিটি অব নর্থ ক্যারোলিনা স্কুল অব মেডিসিনের সাইকিয়াট্রি বিভাগের অ্যাসোসিয়েট ক্লিনিক্যাল প্রফেসর রেইড উইলসন ইউ.এস. নিউজ অ্যান্ড ওয়ার্ল্ড রিপোর্টকে বলেন, “প্রায়ক্ষেত্রে প্যানিক অ্যাটাকের কারণ হচ্ছে স্ট্রেস, যা ছয় থেকে আট মাস ধরে বিদ্যমান আছে।”
অ্যাংজাইটি অ্যাটাকের লক্ষণ:
- আতঙ্কিত হওয়া, ভয় পাওয়া বা অস্বস্তি লাগা
- বিপদ বা ভয়ংকর কিছুর শঙ্কায় থাকা
- ঘুমের সমস্যা হওয়া, অর্থাৎ ঘুম কমে যাওয়া বা বৃদ্ধি পাওয়া
- অস্থির বোধ করা
- হাত-পায়ের তালু ঠাণ্ডা হয়ে যাওয়া বা ঘামা
- গলা শুকিয়ে আসা
- বুক ধড়ফড় করা
- কোনো কাজে মনোযোগ দিতে ব্যর্থ হওয়া
- বমি হওয়া বা বমিভাব হওয়া
- অতিরিক্ত চিন্তা করা, এবং নেতিবাচক চিন্তা করা
- কোনো কিছু সম্পর্কে বা স্থান সম্পর্কে অতিরিক্ত ভীতি কাজ করা
- দমবন্ধ হয়ে আসছে মনে হতে পারে। শ্বাস নিতে কষ্ট হয়েই থাকে।
- কানে শব্দ হওয়া
- অতিরিক্ত মাত্রায় উদ্বেগ
- কান্নাও পেতে পারে যে কোনও সময়ে
- উদ্বেগ বাড়লেই বুক ধড়ফড় করা শুরু হয়
- শরীর-মন সে সময়ে শান্ত থাকে না। তাই প্রায় কোনও কাজে মন দেওয়াও সম্ভব হয় না
- হজমের কোনও অসুবিধা ছাড়াই ক্ষণে ক্ষণে পেট ব্যথা করে কারও কারও
- গরমের মধ্যে হঠাৎ কাঁপুনি বা শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত ঘরে বসেও ঘামতে থাকেন কেউ কেউ
- মনে হয় বুকে যেন ভারী কিছু চাপিয়ে দেওয়া হয়েছে
মধ্যে দু’-তিনটি লক্ষণ থাকলেই একটু সতর্ক হতে হবে।
প্যানিক অ্যাটাকের কারণ
এর সঠিক কোন কারণ এখনো সুস্পষ্ট ভাবে জানা যায় না। তবে বংশ এবং জিনগত বিষয়, উচ্চ মাত্রার শারীরিক ও মানসিক চাপ, মস্তিষ্কের নির্দিষ্ট কিছু অংশের ক্রিয়াকলাপের পরিবর্তন ইত্যাদিকে কারণ হিসেবে ধরা হয়ে থাকে। এছাড়াও দীর্ঘদিন অতিরিক্ত স্ট্রেসের মধ্যে থাকলে, তীব্র মানসিক যন্ত্রণায় থাকলে, কাছের কারও সঙ্গে বিচ্ছেদ হলে, কোনো ধরনের ভয় পেলে, আর্থিক বা ব্যবসায়িকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হওয়া কিংবা কারও মাধ্যমে অপমাণিত হওয়া ইত্যাদিকে প্যানিক অ্যাটাকের সাধারণ কারণ হিসেবে ধরা হয়।
তবে মস্তিষ্কের কিছু রাসায়নিক উপাদান যেমন সেরোটোনিন, নরএপিনেফ্রিন, গামা অ্যামিনো বিউটাইরিক অ্যাসিড (গাবা) ইত্যাদির স্বাভাবিক ভারসাম্য নষ্ট হওয়া এবং ভয় নিয়ন্ত্রণের সঙ্গে সম্পর্কিত স্থান যেমন অ্যামিগডালা, হাইপোথ্যালামাস, হিপপোক্যাম্পাস, প্রিফ্রন্টাল কর্টেক্স ইত্যাদির কাজের ত্রুটির জন্য এটি হয়ে থাকে।
অ্যাংজাইটি অ্যাটাকের কারণ
অ্যাংজাইটি অ্যাটাকের কারণসমূহ এখনো কোনো গবেষণায় পাওয়া যায়নি। একই পরিস্থিতিতে একজনের হয়তো সমস্যা হচ্ছে না, কিন্তু অন্যজন মানসিক চাপে ভুগছেন। অ্যাংজাইটি জন্য দায়ী এড্রেলিন এবং করটিসলের মতো হরমোন।
- তবে বংশপরম্পরায়ও অ্যাংজাইটি অ্যাটাক হতে পারে। কেউ যদি অ্যাংজাইটিতে ভোগে, তাহলে তার বংশের ইতিহাস ঘাটলে দেখা যাবে প্রায় ৩০ শতাংশের মতো মানুষের পরিবারে আগে থেকেই কেউ না কেউ এই রোগে আক্রান্ত ছিলেন।
- এছাড়াও কিছু গবেষণায় দেখা গিয়েছে, মস্তিষ্কের যে অংশগুলো ভয়, আবেগ ইত্যাদি অংশগুলো নিয়ন্ত্রণ করে, সেসব অংশের রাসায়নিক বিক্রিয়ার ত্রুটির কারণেও স্ট্রেস, এংজাইটি হতে পারে।
- ডাক্তারের পরামর্শ ছাড়াই কোনো ওষুধ সেবনে বা অপরিমিত পরিমাণে গ্রহণের ফলে স্নায়ুচাপ থেকে অ্যাংজাইটি হতে পারে।অতিরিক্ত নেশাজাত দ্রব্যের কারণে প্রথমে সামান্য, এবং পরবর্তীতে ক্রমশ অ্যাংজাইটি হতে পারে। আবার হতে পারে হঠাৎ নেশা ছেড়ে দেয়ার ফলে শরীরে যে রাসায়নিক বিক্রিয়া ঘটে তার থেকেও অ্যাংজাইটি হতে পারে। তাই হুট করেই কোনো কিছু থেকে বেড়িয়ে আসা যাবে না। নিজের শরীর যাতে এই তাৎক্ষণিক পরিবর্তনে মানিয়ে নিতে পারে, সেদিকে লক্ষ্য রাখতে হবে।
- শৈশবের কোনো কষ্টদায়ক স্মৃতি, শৈশবে শারীরিক, মানসিক, কিংবা যৌন অত্যাচার মানুষের মনে দাগ কেটে রাখে, যা পরবর্তী সময় অ্যাংজাইটিরূপে প্রকাশ পায়।
- হৃদরোগ, ফুসফুসের সমস্যা, হরমোনাল পরিবর্তন হলেও সাধারণত মানুষের অ্যাংজাইটি হয়ে থাকে।
- পূর্ববর্তী কোনো মানসিক রোগ থাকা, ব্যক্তি পূর্বে কোনো মানসিক রোগ, যেমন ডিপ্রেশনে আক্রান্ত হয়ে থাকলে তার অ্যাংজাইটি হওয়ার সম্ভাবনা খুব বেশি।
- দীর্ঘদিন কোনো রোগে ভুগলে, যেমন- উচ্চ রক্তচাপ, ডায়াবেটিস ইত্যাদি রোগে দীর্ঘ সময় ভুগলে মানুষের মধ্যে অ্যাংজাইটি কাজ করে।
- আত্মসম্মানের অভাব, সাধারণত পারিবারিক কলহ থাকলে সন্তানের আত্মমর্যাদা কম থাকে, এই আত্মসম্মানবোধ বা আত্মবিশ্বাস কম থাকার কারণেও যে কেউ অ্যাংজাইটি অ্যাট্যাকের কবলে পড়তে পারে।
প্যানিক অ্যাটাক ও অ্যাংজাইটি অ্যাটাকের পার্থক্য
এতক্ষণ ব্লগটি পড়ে আপনার মনে হতে পারে যে এদের মধ্যে পার্থক্য কোথায়? দুটোই তো কি৷ আসলে প্যানিক অ্যাটাক ও অ্যাংজাইটি অ্যাট্যাকের মধ্যে কিছু পার্থক্য রয়েছে।
- প্যানিক অ্যাটাক কোনো আগাম বার্তা ছাড়া হুট করেই চলে আসে। অনেকটা ভূমিকম্পের মতন। কোনো বার্তা দেয় না। কিন্তু অন্য দিকে অ্যাংজাইটি অ্যাটাক হওয়ার পেছনে নির্দিষ্ট কারণ থাকে। সেসব কারণ হলো যা আপনাকে ট্রিগার করে, যেগুলো ঘটলে আপনি অস্থিরবোধ করেন। আর সেসব কারণ আপনি চাইলেই এড়িয়ে যাওয়ার চেষ্টা করতে পারেন।
- প্যানিক অ্যাটাক এর লক্ষণগুলো বেশ ভয়াবহ হয়ে থাকে যেমন আপনি মারা যাচ্ছেন এমন অনুভূত হয়। অন্যদিকে অ্যাংজাইটি অ্যাটাকে পরিস্থিতি অনুযায়ী কম বেশি প্রবলতা লক্ষ করা যায়।
- প্যানিক অ্যাটাক হঠাৎ করেই হয় নির্দিষ্ট কোনো সময়সীমা নেই। কিন্তু অ্যাংজাইটি অ্যাটাক আপনি কোনো কিছু নিয়ে চিন্তিত থাকলে ঘন ঘন হতে পারে।
- প্যানিক অ্যাটাক কয়েক মিনিটের জন্য স্থায়ী থাকে কিন্তু অ্যাংজাইটি অ্যাটাক বেশ সময় ধরেই হয়ে থাকে।