আজকে যখন আমি লেখাটি লিখছি তখন পৃথিবীব্যাপী কোভিড -১৯ আক্রান্তের সংখ্যা ২.২ মিলিয়ন এবং প্রাণহানির সংখ্যা ১ লাখ বায়ান্ন হাজার এবং এরই মধ্যে ২১৩ টি দেশে রোগটি ছড়িয়ে পরেছে  ( সূত্র : বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা) | ইউরোপ, আমেরিকা থেকে শুরু করে এশিয়ার প্রত্যেকটা দেশের মত বাংলাদেশেও এর প্রাদুর্ভাব দেখা দিয়েছে । এমতাবস্থায় আমাদের নিজেদের মানসিক ও শারীরিক সুস্থতা নিশ্চিত করা অত্যাবশ্যকীয়। তাই শারীরিক সুস্থতার প্রতি গুরুত্বের পাশাপাশি মানসিক স্বাস্থ্যের প্রতিও একইভাবে গুরুত্ব দেয়া উচিৎ।

একজন মানুষকে মানসিকভাবে সুস্থ থাকতে হলে তার জীবনের তিনটি দিকে গুরুত্ব দেওয়া প্রয়োজন। এই তিনটি দিক বিশ্লেষণের মাধমে করোনা পরিস্থিতিতে নিজেকে ভাল রাখার উপায়গুলো আলোকপাত করা হলো :

১। সামাজিক দিক :

আমি প্রথমেই সামাজিক দিকটির প্রভাব বিশ্লেষণ করছি। আমরা ইতিমধ্যে সবাই জেনেছি যে  করোনা ভাইরাস মোকাবেলায় সামাজিক দূরত্ব প্রধান উপায় হয়ে দাঁড়িয়েছে । মানুষ নানা ভাবে বিভিন্ন সামাজিক  সম্পর্কে জড়িত থাকে যা মানুষের মানসিক স্বাস্থ্য ভাল রাখার ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ অবদান  রাখে । করোনা পরিস্থিতে  দীর্ঘদিন ধরে সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখা, ঘরে থাকা, সামাজিক সকল অনুষ্ঠান, কাজ থেকে দূরে থাকার ফলে মানুষের মানসিক স্বাস্থ্য এর উপর প্রভাব পরতে পারে। সারস- এস১ ফ্লু,  ইবুলা এবং অন্যান্য সংক্রমন ব্যাধির সময় মানুষের মানসিক স্বাস্থ্য এর উপর সামাজিক দুরত্ব, সামাজিক একাকীত্ব এর কি প্রভাব রয়েছে সে সম্পর্কিত ২৪ টি গবেষণা রিভিউ করে দেখা গেছে যে যেসকল ব্যক্তির সামাজিক দুরত্ব, সামাজিক একাকীত্ব ও কোয়ারেন্টাইনে থাকার অভিজ্ঞতা রয়েছে তাদের অনেকের মধ্যেই স্বল্প ও দীর্ঘমেয়াদি মানসিক সমস্যা যেমন চাপ, ইনসমনিয়া,সাবসট্যান্স এবিউজ, উদ্বিগ্নতা, বিষণ্ণতা দেখা দিয়েছিল।

তাই এই সময়টিতে আমরা যেহেতু বাসায়ই থাকছি আমাদের হাতে প্রচুর সময় থাকছে। তাই পরিবার, আপনজন, আত্মীয় স্বজন, বন্ধু বান্ধবদের সাথে মোবাইলে কথা বলার মাধমে সম্পর্কগুলোকে নতুনভাবে যত্ন নিতে পারি এছাড়াও প্রযুক্তি ব্যাবহারের মাধমে আমরা সহজেই পুরনো আত্মীয় স্বজন, বন্ধু বান্ধব যাদের সাথে সময়ের অভাবে অনেকদিন যোগাযোগ করা হয় না তাদের সাথেও ভিডিও বা অডিও কলের মাধমে কথা বলতে পারি। এতে আমাদের মনোবল বৃদ্ধি পাবে ও মনের যত্নও নেয়া হবে ।

২। মানসিক দিক :

নিজের অনুভুতি গুলুর দিকে লক্ষ্য করা ও মেনে নেয়া :  করোনা ভাইরাস এর ফলে প্রতিদিন আক্রান্ত ও মৃতের সংখ্যা জানার ফলে যেকারো মনে স্বাভাবিক ভাবেই উদ্বেগ , চাপ সৃষ্টি হতে পারে | এই লাইনটিতে স্বাভাবিক শব্দটি ব্যাবহার করেছি কারন মনোবিজ্ঞানের ভাষায় উদ্বেগপূর্ণ ঘটনায় উদ্বিগ্ন হওয়া এবং চাপ অনুভব করাই স্বাভাবিক অন্যদিকে যদি উদ্বেগপূর্ণ ঘটনায় কোন উদ্বেগের সৃষ্টি না হয় তাহলে এটি অস্বাভাবিক | তাই মানসিকভাবে দৃঢ় থাকতে প্রথমেই যা করতে হবে তা হচ্ছে  আপনার মধ্যে যে চাপ , উদ্বিগ্নতা তৈরি হয়েছে তা স্বাভাবিক একটি প্রক্রিয়া হিসেবে মেনে নেয়া | এতে আপনার মধ্যে অস্থিরতা আগের চেয়ে অনেকটা কমে আসবে এই ভেবে অনেক মানুষের মধ্যে এরকম অনুভুতি হচ্ছে যা উদ্ভুত পরিস্থিতিতে হওয়াই স্বাভাবিক।

শ্বাস প্রশ্বাসের ব্যায়াম অনুশীলন করা  মনোবিজ্ঞানীরা  শ্বাস প্রশ্বাসের অনেক ধরনের ব্যায়াম করার পরামর্শ দিয়া থাকেন । এই পরিস্থিতিতে আমরা সেরকম কিছু ব্যায়াম অনুশীলন করতে পারি যা উদ্বিগ্নতা ও চাপ কমানোর পাশাপাশি ভালো ঘুমের ক্ষেত্রেও সহায়ক হবে । এছাড়াও শ্বাস প্রশ্বাসের এই ব্যায়াম গুলো ফুসফুসের কার্যকারিতা বৃদ্ধিতেও সহায়ক হবে যা করোনা পরিস্থিতির জন্য গুরুত্বপূর্ণ একটি বিষয় ।

  • গভীর শ্বাস প্রশ্বাসের ব্যায়াম (Deep Breathing exercise) : এই ব্যায়ামটি করার নিয়ম হচ্ছে একটি নিরিবিলি জায়গায় বসে নাক দিয়ে লম্বা করে দীর্ঘ সময় নিয়ে শ্বাস নেয়া, কিছুক্ষণ আটকে রাখা তারপর মুখ দিয়ে ধীরে ধীরে হা করে বের করে দেয়া । এই ব্যায়ামটির  নিয়মিত অনুশীলন উদ্বিগ্নতা ও চাপ কমাতে সাহায্য করবে ।
  • ৪-৭-৮ শ্বাস প্রশ্বাসের ব্যায়াম অনুশীলন  ব্যায়ামটি করার নিয়ম হচ্ছে শান্ত হয়ে সোজা  হয়ে বসে ৪ সেকেন্ড ধরে নাক দিয়ে শ্বাস নেয়া , তারপর ৭ সেকেন্ড ধরে আটকে রাখা এই সময়টিতে মনে মনে ১ থেকে ৭ পর্যন্ত গুনা , সবশেষে মুখ দিয়ে হা করে ৮ সেকেন্ড ধরে  প্রশ্বাস বের করে দেয়া তখন মনে মনে ১ থেকে ৮ পর্যন্ত গুনা । এই চক্রটি একই নিয়মে ৪ বার করা ।

মাইন্ডফুলনেস অনুশীলন করা : মাইন্ডফুলনেস এমন একটি মানসিক অবস্থা যেখানে একজন ব্যাক্তি তার সম্পূর্ণ মনোযোগকে বর্তমানে কেন্দ্রীভূত করে থাকে । অর্থাৎ কি ভাবছে, কি করছে তা সম্পর্কে সম্পূর্ণ সচেতন থাকা । অতিতে কি হয়েছিল, ভবিষ্যতে কি হবে তা নিয়া মগ্ন না থাকা । যেমন এই সময়টিতে অনেকেই চিন্তা করছে ভবিষ্যতে যেকোনো সময় সে নিজেও করোনায় আক্রান্ত হতে পারে, হলে কি হবে , এমন কি মৃত্যুও হতে পারে এই ধরনের ভবিষ্যৎ নিয়ে দুশ্চিন্তার ফলে তাদের মধ্যে উদ্বিগ্নতা, বিষন্নতার সৃষ্টি হচ্ছে । তাই এই সময়টিতে মাইন্ডফুলনেস অনুশীলন নেতিবাচক চিন্তাভাবনা থেকে দূরে থাকতে সহায়ক হবে ।

ইতিবাচক চিন্তা করা :  করোনা পরিস্থিতিতে নানা ধরনের নেতিবাচক চিন্তা স্বাভাবিক ভাবেই আমাদের মনে উদয় হচ্ছে । এই নেতিবাচক চিন্তার ফলে নানান নেতিবাচক অনুভুতি যেমন উদ্বিগ্নতা, বিষণ্ণতা হচ্ছে । এই পরিস্থিতিতেও আমরা যদি ইতিবাচক দিক গুলোতে লক্ষ্য করি তাহলে এইসব নেতিবাচক চিন্তার জায়গায় ইতিবাচক চিন্তার প্রতিফলন ঘটতে পারে। যেমন ,আমরা যদি বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার দেয়া ১৭ এপ্রিল ২০২০ পর্যন্ত করোনায় আক্রান্ত এবং সুস্থ হয়ে উঠা রুগীর সংখ্যা লক্ষ্য করি তাহলে দেখতে পাব ২১ লাখ ৩৯ হাজার আক্রান্ত মানুষের মধ্যে ৫ লক্ষ ৫২ হাজার মানুষ সুস্থ হয়েছে । আক্রান্ত রুগীর একটা বড় অংশ সুস্থ হয়ে ওঠেছে যা কিছুটা হলেও ইতিবাচক চিন্তা করতে সাহায্য করবে ।

করোনা পরিস্থির খবর নির্দিষ্ট সময় পর দেখার জন্য নিজেকে মানসিকভাবে প্রস্তুত করা : আমরা এখন সবচেয়ে বেশি উদগ্রীব থাকি করোনা পরিস্থিতির খবর প্রতিনিয়ত পাওয়ার জন্য । এর ফলে মনের মধ্যে সবসময় একটা অস্থিরতা বিরাজ করে । তাই করোনা পরিস্থিতির খবর দিনের একটি নির্দিষ্ট সময়ে দেখার জন্য নিজের মস্তিষ্ককে মেসেজ দেয়া যে নির্দিষ্ট সময়েই আমরা সংবাদ দেখব একই সাথে সামজিক যোগাযোগ মাধ্যম এর ব্যাবহার ও আগের চেয়ে কমিয়ে আনলে তা এই ধরনের মানসিক প্রস্তুতির ক্ষেত্রে সহায়ক ভুমিকা পালন করবে ।

মনের যত্ন নেয়া: মনোবিজ্ঞানীরা যেকোনো পরিস্থিতিতে মনের যত্ন নেয়ার উপর সর্বাধিক গুরুত্ব দিয়া থাকেন । তাই এই পরিস্থিতিতে ইতিবাচক থাকার জন্য মনের যত্ন নেয়া গুরুত্বপূর্ণ । একজন  ব্যাক্তি বিভিন্ন উপায়ে মনের যত্ন নিতে পারে ।এক্ষেত্রে বাক্তি বিশেষে পার্থক্য হতে পারে ।

মনের যত্ন নেয়ার কিছু উপায় :

  • নিয়মিত মেডিটেশন করা । মেডিটেশন বা ধ্যান  ইতিবাচক চিন্তার প্রকাশ ঘটাতে  ও উদ্বিগ্নতা, বিষণ্ণতা কমিয়ে মনকে প্রফুল্ল রাখতে সাহায্য করে ।
  • মনের যত্নে ব্যায়াম একটি উপকারী উপায় । যেহেতু এই সময়টিতে ঘরেই থাকা হচ্ছে তাই ঘরেই নিয়মিত ফ্রী হ্যান্ড ব্যায়াম, যোগব্যায়াম করতে পারি । নিয়মিত ব্যায়াম  মস্তিষ্কে রক্ত সঞ্চালন বাড়ায়  যা চাপ, উদ্বিগ্নতা কমায় ও ভাল ঘুমের ক্ষেত্রেও সাহায্য করে ।
  • পরিবারকে গুণগত সময় দেয়া । গুণগত সময় বলতে বুঝানো হচ্ছে আমরা পরিবারের থেকেও সম্পূর্ণ ভাবে পরিবারের মানুষ গুলোকে সময় দেই না। খাবারের টেবিলে সবাই একসাথে  বসেও হয়ত প্রত্যেকের মোবাইল নিয়ে ব্যাস্ত থাকি, আবার অনেক সময় শিশুদের সাথে কাটানো সময়ের মাঝেই আমরা মনের অজান্তেই হয়ত অন্য কাজে ব্যাস্ত হয়ে যাই, মোবাইলেও অন্য কিছু করতে থাকি যা আমাদের পরিবারকে গুনগত সময় দিতে বাঁধা দিচ্ছে । তাই এই সময়টিতে আমরা পরিবারকে গুণগত সময় দিতে মনযোগী হতে পারি, এছাড়াও পরিবারের সদস্যরা সবাই মিলে বিভিন্ন  খেলায় অংশগ্রহণ করতে পারি , তাদের নিয়ে সৃজনশীল কাজ করতে পারি এতে মন প্রফুল্ল থাকার পাশাপাশি মানসিক বিকাশ ঘটাতেও সহায়ক হবে ।
  •   পছন্দের কাজ করা যেমন বই পড়া, গাছের যত্ন নেয়া, গান শুনা, প্রিয় রান্নাটি করা,  প্রিয়জনের সাথে সময় কাটানো ইত্যাদি ।
  • সৃজনশীল বিভিন্ন কাজে  নিজেকে নিয়োজিত করা। যেমন সেলাই করা, পেইন্টিং করা, ঘরে থাকা পুরনো জিনিষ দিয়ে নতুন কিছু তৈরি করা ইত্যাদি ।

প্রয়োজনে মানসিক স্বাস্থ্য সেবা দানকারী সংস্থাগুলো থেকে অনলাইন ভিত্তিক মানসিক স্বাস্থ্য সেবা নেয়া  : এই দুর্যোগকালীন সময়ে কিছু  মানসিক স্বাস্থ্য সেবা দানকারী প্রতিষ্ঠান এগিয়ে এসেছে যারা অনলাইন ভিত্তিক মানসিক স্বাস্থ্য সেবা দিয়ে যাচ্ছে । তাই করোনা পরিস্থিতিতে যাদের মানসিক বিভিন্ন সমস্যা দেখা দিচ্ছে তারা অনলাইন ভিত্তিক কাউন্সেলিং/ সাইকোথেরাপি গ্রহন করতে পারবে । নিচে তেমনি কিছু প্রতিষ্ঠানের নাম উল্লেখ করা হল :

১। সাইকিউর অরগানাইজেশন এর লাইভ চ্যাট প্রোগ্রামের মাধ্যমে বিশেষজ্ঞ মনোবিজ্ঞানীরা অনলাইন ভিত্তিক কাউন্সেলিং সেবা দিয়ে থাকেন ।

২। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এডুকেশনাল অ্যান্ড কাউন্সেলিং সাইকোলজি বিভাগ মানসিক স্বাস্থ্যসেবা প্রদান করছে। আগামী ৩০ মে পর্যন্ত সকাল ৮ টা থেকে রাত ৯টা পর্যন্ত মোবাইল ফোন, ইমেইল ও স্কাইপের মাধমে সেবাটি গ্রহন করা যাবে ।

৩। ব্রাক ‘মনের যত্ন মোবাইলে‘ নামক একটি জরুরী টেলিকাউন্সেলিং সেবা চালু করেছে যা চাপ, রাগ, ভয় বা অন্য কোনো মানসিক সমস্যা সম্পর্কিত টেলিকাউন্সেলিং সেবা দিচ্ছে । তাদের হটলাইনের ০১৭০৯৮১৭১৭৯ নম্বরে সকাল ৮ টা থেকে রাত ১২ টার মধ্যে ফোন দিয়ে সেবাটি গ্রহন করা যাবে ।

৩। শারীরিক দিক :

শারীরিক ও মানসিক সুস্থতা একটি অপরটির সাথে জড়িত । করোনা পরিস্থিতিতে শরীরের রোগপ্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ানো খুব জরুরি । কিন্তু করোনা পরিস্থিতিতে আমরা বেশীরভাগ সময় উদ্বিগ্ন থাকার ফলে আমাদের রোগপ্রতিরোধ ক্ষমতা উল্টো কমছে । তাই এই পরিস্থিতিতে উদ্বিগ্নতা কমাতে নিয়মিত মেডিটেশন ও ব্যায়াম করা একই সাথে রোগপ্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়াতে সাহায্য করে এমন খাবার যেমন ভিটামিন সি, ডি সমৃদ্ধ খাবার খাওয়া এবং পর্যাপ্ত পরিমানে ঘুমানো প্রয়োজন । এছাড়াও বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা থেকে দেওয়া স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলাও খুব গুরুত্বপূর্ণ। এভাবে সম্পূর্ণভাবে লাইফস্টাইল এ ইতিবাচক পরিবর্তন আনার মাধমে আমরা শারীরিক সুস্থতা নিশ্চিতের পাশাপাশি মানসিক সুস্থতা নিশ্চিত করতে পারি ।

পরিশেষে বলা যায় করোনা পরিস্থিতিতে শারীরিক  ও মানসিক ভাবে ভাল থাকার জন্য আমাদের সচেতনতা বৃদ্ধি করতে হবে । প্রত্যেকটি মানুষের তার জায়গা থেকে ভাল থাকার চেষ্টাই সার্বিকভাবে সকলের ভালো থাকা নিশ্চিত করবে।  সর্বোপরি “ নিজে শারীরিক  ও মানসিক ভাবে সুস্থ থাকবো অন্যকেও সুস্থ রাখব “।

Psycure

Scroll to Top