স্কুল কিংবা হাই স্কুলে পড়াকালীন সময়ে কিংবা এখনো যারা স্কুল বা হাই স্কুলে পড়ছেন তাদের অনেকেরই সবচেয়ে অপছন্দের পাঠ্যবই বা বিষয়ের তালিকার শুরুর দিকেই থাকবে “সমাজ” নামে পরিচিত বই টি। ছোটবেলায় এই বইটি  আমাদের অপছন্দনীয় হলেও বয়স বাড়ার সাথে সাথে সমাজব্যবস্থা বা সমাজের মানুষজন যেন আমাদের অপছন্দের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। আমরা অনেকেই আবার সমাজ বা সমাজের মানুষের দ্বারা ভীতসন্ত্রস্ত হয়ে থাকি। অবশ্যই এর পেছনে বেশ কিছু কারণ ও সমস্যা রয়েছে। মনোবিজ্ঞানের ভাষায় সমাজ বা মানুষের প্রতি ভীতিকে  Anthropophobia বলা হয়। “Anthro” অর্থ মানুষ এবং “Phobia” অর্থ ভয় বা ভীতি। যদিও এটাকে ক্লিনিক্যাল ডিসওর্ডার (Clinical Disorder)  হিসেবে চিহ্নিত করা হয় নাহ।  বেশিরভাগের মতে এটি সোশ্যাল অ্যাংজাইটি ডিসঅর্ডার (Social Anxiety Disorder) এর একটি অংশ।

 

পুথিগত বিদ্যায় আমরা জেনেছি, মানুষ সামাজিক জীব। নানান কারণে মানুষকে সমাজবদ্ধ হয়ে বসবাস করতে হয়। সমাজের নানান মানুষের সাথে ওঠা বসা করতে হয়। ভাবের আদান প্রদান করতে হয় এবং নিজের বিকাশ সাধন করতে হয়। তবে নানান কারণে আমাদের আশেপাশের অনেক মানুষই সমাজের অন্য মানুষের সাথে সহজে মিশতে পারেন না অথবা সমাজে বিভিন্ন কার্যকলাপ বা অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণ করার ক্ষেত্রে তারা বিভিন্ন মানসিক বাধার সম্মুখীন হন। অনেকাংশে এসব সমস্যা তাদের মানসিক স্বাস্থ্যের উপর বিরূপ প্রভাব ফেলে। এমন কি অবস্থা গুরুতর হলে সেটি শারীরিক ক্ষতিও করতে পারে। চলুন তাহলে জেনে নেই কি কি কারণে একজন মানুষ Anthropophobia তে  ভুগে থাকেন।

ANTHROPOPHOBIA এর কারণঃ

নানান কারণে একজন মানুষ এই ফোবিয়ায় আক্রান্ত হতে পারেন। তবে সাধারণত যে সকল কারণে একজন মানুষ Anthropophobia আক্রান্ত হয়ে থাকে, সেই বিষয়গুলো আমরা এখানে আপনাদের কাছে তুলে ধরার চেষ্টা করব।

 

★সমাজ বা ব্যক্তির থেকে নেতিবাচক আচরনঃ

স্বভাবগত ভাবেই আমরা মানুষরা অন্য মানুষের থেকে সুন্দর আচরণ ও ব্যবহার আশা করি। অন্য মানুষের থেকে সুন্দর আচরণ বা ব্যবহার আমাদেরকে যেমন আনন্দিত করে, ঠিক তেমনি আমাদের মনকে প্রফুল্ল রাখে। একইভাবে খারাপ বা নেতিবাচক ব্যবহারগুলো আমাদের জীবনে এবং আমাদের চিন্তা-চেতনায় বিরূপ প্রভাব ফেলে। আমাদের মাঝে যারা অতিরিক্ত চিন্তা করেন যাকে আমরা ওভার থিংকিং (Overthinking)  হিসেবে চিনি, তারা এসকল বিষয় নিয়ে অতিরিক্ত মাথা ঘামান। ফলশ্রুতিতে তারা নেতিবাচক বিভিন্ন কথা বা মন্তব্যের ব্যাপারে খুবই সংবেদনশীল হয়ে থাকেন। ধীরে ধীরে তারা মানুষদের সাথে মেলামেশা করার ক্ষেত্রে নিজেদেরকে গুটিয়ে ফেলেন। নিজেদেরকে একঘেয়ে করে ফেলেন এবং সর্বোচ্চ চেষ্টা করেন মানুষদেরকে এড়িয়ে চলতে। এটা সত্যি যে আমরা কেউই নেতিবাচক মন্তব্য পছন্দ করি না।  তবে নেতিবাচক মন্তব্য কে নিজের শত্রু কিংবা ভয়ের কারণ হিসেবে কখনোই গ্রহণ করা যাবে না।

 

★পারিপার্শ্বিক পরিবেশঃ

মনস্তাত্ত্বিক বিষয়গুলোর উপর পারিপার্শ্বিক পরিবেশের অনেক বড় একটি প্রভাব রয়েছে। পারিপার্শ্বিক প্রভাব শুধু যে ইনভারমেন্টাল (Environmental)  পরিবেশ বা বায়োলজিক্যাল (Biological)  পরিবেশকে বোঝায় তা নায়। আমাদের আশেপাশের মানুষ, আমাদের বন্ধুবান্ধব কিংবা আমাদের পরিবার আমাদের মনস্তাত্ত্বিক বিষয় বা আমাদের সামগ্রিক বিষয় গুলোর প্রতি কতটুকু সচেতন কিংবা কতটুকু সহমর্মিতা প্রকাশ করছেন সেটি একটি বড় বিষয়।  আমাদের আশেপাশের পরিবেশ সুন্দর ও বন্ধুসুলভ হলে আমাদের মন এবং শরীর আপনা-আপনি ভালো থাকে। আপনি হয়তো খেয়াল করেছেন জীবনে অনেক ক্ষেত্রে আপনার আশেপাশের পরিবেশের কারণে আপনি নানাভাবে হীনমন্যতায় ভুগেছেন কিংবা নিজেকে অসহায় মনে হয়েছে। নিশ্চয়ই ঐ মুহুর্তগুলো থেকে সবসময় পালিয়ে বাঁচার চেষ্টা করেছেন। তবে সবক্ষেত্রে সব কিছু যেমন এড়িয়ে চলা যায় না, ঠিক তেমনি পালিয়েও বাচাঁ যায় নাহ।  এ সকল ক্ষেত্রে আমাদের নিজেদের উপর নিজেদের নিয়ন্ত্রণ এবং মনস্তাত্ত্বিক বিষয়গুলোকে সঠিকভাবে উপলব্ধি ও উন্নতি আমাদের জন্য একটু আশীর্বাদ হতে পারে।

 

★অপ্রীতিকর ঘটনা এবং অনাকাঙ্খিত অভিজ্ঞতাঃ

হাতের পাঁচটা আঙুল যেমন সমান নয় ঠিক তেমনি, সমাজের পাঁচ জন মানুষও সমান নয়। প্রতিদিন নানান কাজে নানান মানুষের সাথে আমাদের ওঠা বসা করতে হয়। সব সময় তাদের কাছ থেকে আমরা আশানুরূপ আচরণ পেয়ে থাকি নাহ। অনেক সময় অনেক দুর্ঘটনা আমাদের সাথে ঘটে যেতে পারে।  এসব দুর্ঘটনা কিংবা অনাকাঙ্ক্ষিত পরিস্থিতি ব্যক্তি সাপেক্ষে আমাদের মানসিক স্বাস্থ্যের উপর নানাবিধ প্রভাব ফেলে থাকে। আমরা যারা নিজেদের আবেগের উপর নিয়ন্ত্রণ রাখতে পারি, তারা অনেক ক্ষেত্রেই এসব পরিস্থিতি কাটিয়ে উঠতে পারলেও ;এসকল ব্যপারে খুব বেশি দক্ষ নায়, তারা  অনেক সময় চরম ভাবে এই Anthropophobia  আক্রান্ত হয়ে পড়েন। ফলশ্রুতিতে তারা সহজে কোন মানুষের সাথে মিশতে পারেন না।  কোন মানুষের সাথে কথা বলার পূর্বে বা তাদের সাথে কোন কাজ করার পূর্বে তার মস্তিষ্কে একটি নেতিবাচক চিন্তা ঘুরপাক খেতে থাকে। যার ফলে তিনি তার পূর্বনির্ধারিত কাজ কি সঠিক উপায়ে সম্পন্ন করতে পারেন না। একটা সময় এসে এসকল মানুষ আর স্বাভাবিকভাবে কারো সাথে কোন বিষয়ে মতবিনিময় বা নিজের মতামত তুলে ধরতে পারেন না।

 

★বংশগত বা জন্মগত সমস্যাঃ

সচরাচর বন্ধুমহলে আমরা দুটি শব্দ খুব বেশি ব্যবহার করে থাকে। একটি হলো ইন্ট্রোভার্ট (Introvert)   অপরটি হল এক্সট্রোভার্ট (Extrovert) । আমাদের মাঝে অনেকেই থাকেন, যারা একদম ছোটবেলা থেকেই মানুষদের সাথে খুব বেশি একটা মিশতে পারেন না। আবার অনেকে থাকেন যারা খুব সহজেই যে কোন মানুষের সাথে সহজেই মিশে যেতে পারেন। মানুষের সাথে না মিশতে মিশতে একটা সময় আসে কোন ব্যক্তির জীবনে এটি একটি ফোবিয়া বা ডিসঅর্ডার হিসাবে পরিলক্ষিত হতে পারে।

 

★কুসমালোচনার ভীতিঃ

সমালোচনা গ্রহণ করতে পারাটা অত্যান্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি ব্যক্তিগত দক্ষতা। খুব কম মানুষই সমালোচনা গ্রহন করতে সক্ষম হয়। তবে নিজের জানা অজানা যে কোন বিষয়ে সমালোচনা করতে সমাজের মানুষজন বিন্দু পরিমান ছাড় দিতে চান না। অনেক ক্ষেত্রে তারা এমন সমালোচনা করে ফেলেন, যা একজন মানুষের জন্য কাল হয়ে দাঁড়ায়। অহেতুক এসব আলোচনা একজন মানুষের মনোবল খুব সহজেই ভেঙে ফেলে। অনেক ক্ষেত্রে কু-সমালোচনার অভিজ্ঞতা থেকে একজন মানুষ Anthropophobia আক্রান্ত হতে পারেন।

 

ইতিমধ্যে  Anthropophobia সম্পর্কে আমরা বেশ কিছু তথ্য জেনেছি। বলতে পারবেন কোন কোন লক্ষণ এর পরিপ্রেক্ষিতে এই ফোবিয়াটি চিহ্নিত করা হয়। চলুন এবার তাহলে জেনে নেই, কোন কোন লক্ষণ এর সাপেক্ষে আমরা Anthropophobia চিহ্নিত করতে পারি।

ANTHROPOPHOBIA এর লক্ষণঃ

  • সামাজিক বিভিন্ন অনুষ্ঠান কিংবা মানুষকে নিয়ে উদ্বিগ্ন থাকা,
  • মানুষের সাথে মিশতে হবে এমন পরিস্থিতি নিয়ে উদ্বিগ্ন হয়ে পড়া,
  • সম্ভব হলে এ পরিস্থিতিগুলো এড়িয়ে চলার চেষ্টা করা,
  • এই বিষয়টিকে নিয়ে অতিরিক্ত চিন্তা করা,
  •  মানুষের সাথে মিশতে কিংবা কথা বলতে অনীহা প্রকাশ করা।

 

তাছাড়া শারীরিক কিছু লক্ষণও পরিলক্ষিত হতে পারে। যেমন ধরুন,

  • মানুষের সাথে কথা বলার সময় কিংবা পরিস্থিতি সাপেক্ষে অতিরিক্ত ঘামা,
  • হৃদস্পন্দন বেড়ে যাওয়া,
  • কথা বলার সময় জড়তা সৃষ্টি হওয়া,
  • হাত পায়ে কম্পন সৃষ্টি হওয়া,
  • মাথা ব্যথা করা,
  • অতিরিক্ত চিন্তার ফলে কান্না করা,
  • অতিরিক্ত চিন্তা করে দুর্ব্যবহার করা, ইত্যাদি।

 

এসকল লক্ষণের মাধ্যমে Anthropophobia চিহ্নিত করা যেতে পারে। তবে এসব লক্ষণ দেখা দিলেই যে Anthropophobia হয়েছে বিষয়টি এমন নয়। বিশেষজ্ঞের পরামর্শ এবং পরীক্ষার মাধ্যমে নিশ্চিত হতে হবে প্রকৃতপক্ষে কোন ফোবিয়ায় আক্রান্ত হয়েছেন।

 

আশাকরি এতক্ষণে আপনারা Anthropophobia  উপর একটি সামগ্রিক ধারণা পেয়েছেন। চলুন তাহলে এবার জেনে নেই, Anthropophobia থেকে পরিত্রাণের উপায় গুলি।

সমাধানের উপায়ঃ

সাধারণত বিভিন্ন থেরাপির মাধ্যমে এ সকল ফোবিয়া ও সমস্যাগুলোর চিকিৎসা করা হয়ে থাকে। সে ক্ষেত্রে চিকিৎসকের পরামর্শ অনুযায়ী, ট্রেডিশনাল টক থেরাপি (Traditional Talk Therapy),  এক্সপোজার থেরাপি (Exposure Therapy), কগনিটিভ থেরাপি (Cognitive Therapy)  গ্রহণ করা যেতে পারে।

এছাড়াও ব্যক্তিগত কিছু নিয়ম কানুন অনুসরণ মাধ্যমেও এ সমস্যা থেকে পরিত্রাণ পাওয়া যেতে পারে।  যেমন ধরুন,

  • নিজের উপর নিয়ন্ত্রণ রাখা,
  • অবান্তর চিন্তা থেকে নিজেকে বিরত রাখা,
  • চেষ্টা করা সকল ক্ষেত্রে সুচিন্তা করা,
  • কোন বিষয় নিয়ে ভীত না হয়ে, ওই বিষয় নিয়ে আশাবাদী থাকা,
  •  কাউকে নিয়ে ভীতিকর চিন্তা না করে, নিজেকে সাহসী হিসেবে তুলে ধরা,
  • বিভিন্ন ধরনের শরীরচর্চামূলক কাজ নিজের আত্মবিশ্বাস গড়ে তুলতে সাহায্য করতে পারে,
  •  নিয়মিত মেডিটেশন (Meditation) বা ধ্যান করা, ইত্যাদি।

এ বিষয় গুলো পালনের চেষ্টা করলে একজন ব্যক্তি নিজেকে আত্মবিশ্বাসী এবং সফল মানুষ হিসেবে গড়ে তুলতে পারবেন।

 

অনেকেরই এক বা একাধিক বিষয়ের উপর বিভিন্ন পর্যায়ের ভীতি কাজ করে। কোন বিষয় ভীত হওয়া দোষের কিছু নয়। তবে চেষ্টা করতে হবে সেই ভীতি কাটিয়ে উঠে, নিজেকে যোগ্য ও সফল মানুষ হিসেবে গড়ে তুলা। কোন বিষয়ে ভীতি থাকলে সেটিকে নিজের মাঝে লুকিয়ে না রেখে কিংবা সেটি নিয়ে হীনমন্যতায় না ভুগে, পরিবার, বন্ধু ও প্রয়োজন সাপেক্ষে বিশেষজ্ঞের পরামর্শ গ্রহণ করতে হবে।

ভয়কে অবহেলা নয়, জয় করুন।  নিজেকে গড়ে তুলুন একজন আদর্শ ও সবার প্রিয় মানুষ হিসাবে।  নিজে সচেতন হন এবং অন্যকেও অন্যের ভীতি দূর করতে ও সামনের দিকে এগিয়ে যেতে সাহায্য করুন। পারস্পরিক সাহায্য, সহমর্মিতাই একটি সুন্দর এবং বাসযোগ্য পৃথিবী গড়ে তুলতে সক্ষম। নিজে ভালো থাকুন, ভালো রাখুন নিজের পরিবেশকে, নিজের আপনজন ও আশেপাশের মানুষদের কে। আমরা ভালো থাকলেই, ভালো থাকবে পৃথিবী।

Ali Mortuza

Scroll to Top