সিগমুন্ড ফ্রয়েড একজন অস্ট্রিয়ান নিউরোলজিস্ট, বিংশ শতাব্দীর অন্যতম চিন্তাবিদ আধুনিক মনোবিজ্ঞানের জনক। ৬মে ১৮৫৬ সালে অস্ট্রিয়ায় এক ইহুদী পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন l

শিক্ষা ও কর্মজীবন :

১৭ বছর বয়সে ভিয়েনা বিশ্ববিদ্যালয়ের মেডিকেল অনুষদে ভর্তি হন। ১৮৮১ সালে পাস করে ভিয়েনা জেনারেল হাসপাতালে চিকিৎসক হিসেবে কাজ করার পাশাপাশি বেশ কিছু গবেষণাপত্র প্রকাশ করে আলোচিত হন তিনি। ১৮৮৬ সালে ফ্রয়েড ভিয়েনা জেনারেল হাসপাতাল ছেড়ে নিজের ক্লিনিকে অনুশীলন শুরু করেন। তিনি মনোসমীক্ষণ নামক মনোচিকিৎসা পদ্ধতির উদ্ভাবন করেন। ‘মানব সত্বার অবচেতন’, ‘ফ্রয়েডিয় স্খলন, ‘ আত্মরক্ষা প্রক্রিয়া এবং স্বপ্নের প্রতিকী’ ব্যাখ্যা সহ অনেক মনোধারণা তিনি প্রদান করেন।

১৯০৩ খৃষ্টাব্দে সিগমুন্ড ফ্রয়েড ‘দ্যা ইন্টার প্রেটেশন অব ড্রীম ও সাইকো প্যাথলজি অব এভরিডে লাইফ’ নামে দুটি বই লিখে পরিচিত হন। এই বই দুটিতে তিনি মানসিক রোগগ্রস্ত মনের প্রকৃতি বিশ্লেষণ করে স্বাভাবিক মনের ঠিকানা খুঁজতে প্রয়াসী হয়েছেন। ১৯০৫ সালে তিনি শিশুদের মনের প্রবৃতি নিয়ে গবেষণা করে ‘লিবিডো তত্ত্বে’র উদ্ভাবন করে মনোবিজ্ঞানকে অনন্য অবস্থানে তোলে নিয়ে আসেন।

১৯৩০ সালে ফ্রয়েড মনোবিজ্ঞান ও সাহিত্যে অবদানের জন্য গোথে (Goethe) পুরষ্কারে ভূষিত হন।

ফ্রয়েডের কিছু উল্লেখযোগ্য বই:

স্টাডিজ অন হিস্টেরিয়া(১৮৯৫), দ্য ইন্টারপ্রিটেশন অব ড্রিমস (১৯০০), দ্য সাইকোপ্যাথলজি অব এভরি ডে লাইফ(১৯০১), জোকস এন্ড দেয়ার রিলেশন টু আনকন্সাস (১৯০৫), ইন্ট্রোডাকশন টু সাইকো এনালাইসিস (১৯১৭), দ্য ফিউচার অব এন ইলিউশান (১৯২৭)।

পারিবারিক জীবন:

১৮৮৬ সালে ফ্রয়েড মার্থা বার্নেইসকে বিয়ে করেন। মার্থা বার্নেইস ছিলেন হামবার্গের প্রধান ইহুদী আইনজ্ঞ আইজেক বার্নেইসের নাতনী। ফ্রয়েড ছয় সন্তানের জনক। তাঁর ছয় সন্তান হলেন ম্যাথিলডি ( জন্ম: ১৮৮৭), জিন মার্টিন(জন্ম:১৮৮৯), অলিভার(জন্ম:১৮৯১), আর্নস্ট( জন্ম:১৮৯২), সার্ফি(জন্ম:১৮৯৩) এবং এনা (জন্ম: ১৮৯৫)। ১৯৩৮ সালে নাৎসিদের ভয়ে ফ্রয়েডকে ভিয়েনা ছাড়তে হয়। ভিয়েনা ছাড়ার আগে ১৮৯১ থেকে ১৯৩৮ সাল পর্যন্ত ফ্রয়েড ও তাঁর পরিবার একসাথে ভিয়েনার ঐতিহাসিক জেলা ইনারে স্টেট এর কাছাকাছি একটা এপার্টমেন্টে বসবাস করতেন। মার্থা বার্নেইসের মৃত্যুর পর ১৮৯৬ সাল থেকে তার বোন মিনা বার্নেইস ফ্রয়েডের সাথে স্থায়ীভাবে থাকতে শুরু করেন।

সিগমন্ড ফ্রয়েডের উল্লেখযোগ্য সূত্র: ফ্রয়েড বিশ্বাস করতেন, আমাদের শৈশবের অভিজ্ঞতা ব্যক্তিত্ব গঠনের প্রধান চালিকাশক্তি। ছেলেবেলায় নেতিবাচক পরিস্থিতির স্বীকার ব্যক্তি বড় হয়েও ঐ অভিজ্ঞতার ফল বয়ে নিয়ে বেড়ায়। তিনি আরো বলেন, যখন আমরা নিজেদের সম্পর্কে বলি খুব কম সত্য উপস্থাপন করি। এর মানে এমন নয় যে, আমরা মিথ্যাবাদী। বরং আমরা প্রতারক। আমরা সবচেয়ে বড় প্রতারণা করি নিজের সাথে। নিজের সম্পর্কে একটা ধোঁয়াশার মধ্যে থাকি সবসময়। ফ্রয়েড সবচেয়ে বেশি কাজ করেছেন মানুষের ব্যক্তিত্ব নিয়ে।

ফ্রয়েডের কিছু উল্লেখযোগ্য উক্তি:

“অব্যাক্ত অনুভূতি কখনো মরে না। তাদের জীবন্ত সমাধিস্থ করলে বারবার ফিরে আসে আরো ভয়াবহ রূপ নিয়ে।” “নিজের কাছে সৎ থাকা একটি ভালো চর্চা”।

ক্যান্সার :

১৯২৩ সালের ফেব্রুয়ারিতে, ফ্রয়েড তার মুখগহ্ব‌রে অতিরিক্ত ধূমপানের ফলে সৃষ্ট লিউকোপ্লাকিয়া নামক একটি মৃদু জমাট মাংসপিন্ড দেখতে পান। ফ্রয়েড শুরুতে তা গোপন রাখেন, কিন্তু ১৯২৩ সালের এপ্রিলে তিনি আরনেস্ট জোনসকে জানান যে, জমাট মাংসপিন্ডটি কেটে বাদ দেওয়া হয়েছে। ফ্রয়েড চর্মরোগ-বিশেষজ্ঞ ম্যাক্সিমিলিয়ান স্টেইনারের শরণাপন্ন হন, যিনি তাকে ধূমপান করতে নিষেধ করেন কিন্তু মাংসপিন্ডের ঝুঁকে গুরুত্ব কম দিয়ে তা সম্পর্কে‌ মিথ্যা বলেন। ফ্রয়েড এরপর ফেলিক্স ডাচের শরণাপন্ন হন, যিনি মাংসপিন্ডটিকে ক্যান্সার হিসেবে সনাক্ত করেন; তিনি মাংসপিন্ডটিকে অপেক্ষাকৃত শ্রুতিমধুর শব্দ এপিথেলিওমা হিসেবে সম্বোধন করার মাধ্যমে ফ্রয়েডকে বিষয়টি অবহিত করেন। ডাচ তাকে ধূমপান বন্ধ করার এবং মাংসপিন্ডটি কেতে ফেলার নির্দে‌শ দেন। এরপর ফ্রয়েড রাইনোলজিস্ট বা নাক-বিশেষজ্ঞ মারকাস হ্যাজেকের কাছে চিকিৎসা নেন, ইতোঃপূর্বে‌ যার যোগ্যতা সম্পর্কে ফ্রয়েড নিজেই প্রশ্ন তুলেছিলেন। হ্যাজেক তার ক্লিনিকের বহিরাগত ডিপার্ট‌মেন্টে ফ্রয়েডের একটি নিরর্থক-নিষ্প্রয়োজন কসমেটিক সার্জা‌রি করেন। অস্ত্রপচারের সময় ও পরবর্তী‌তে ফ্রয়েডের উল্লেখযোগ্য হারে রক্তক্ষরণ হয়, এবং তিনি অল্পের জন্য মৃত্যুর হাত থেকে বেঁচে যান। ফ্রয়েড এরপর আবার ডাচকে দেখান। ডাচ লক্ষ্য করেন যে, ফ্রয়েডের আবারো অস্ত্রপচার প্রয়োজন হবে, কিন্তু তিনি ফ্রয়েডকে জানাননি যে, ফ্রয়েড ক্যান্সারে আক্রান্ত, কারন তার ভয় ছিল, এটি জানালে ফ্রয়েড হয়তো আত্মহত্যা করতে চাইবেন।

মৃত্যু :

১৯৩৯ সালের সেপ্টেম্বরের মাঝামাঝির দিকে, ফ্রয়েড তার চোয়ালের ক্যান্সারের কারণে ব্যাপক যন্ত্রণা অনুভব করতে থাকেন এবং চিকিৎসক তার এই যন্ত্রণাকে অনিয়ন্ত্রণযোগ্য বলে ঘোষণা করেন। তিনি তার বন্ধু চিকিৎসক ও প্রাক্তন সহ-শরণার্থী‌ ম্যাক্স স্কার-এর সঙ্গে স্বেচ্ছামৃত্যুর ব্যাপারে যোগাযোগ করেন। ম্যাক্স স্কার ও কন্যা আনা ফ্রয়েডের সঙ্গে যৌথ পরামর্শ‌ করে অবশেষে ১৯৩৯ সালের ২৩শে ডিসেম্বর অধিক মরফিন গ্রহণের মাধ্যমে স্বে‌চ্ছামৃত্যু হিসেবে আত্মহত্যা করে মৃত্যুবরণ করেন। তাঁর চিকিৎসক জানিয়েছিলেন যে, আত্মহত্যার প্ররোচনায় ধূমপানজনিত কারণে মুখের ক্যান্সারই এর জন্যে দায়ী।

Psycure

Scroll to Top