আপনার আশেপাশে পরিচিত জন দের মাঝে এরকম মানুষ দেখেছেন বা শুনেছেন? – যাদের কে শুচিবাই বলা হয়ে থাকে? কি রকম স্বভাবের হয় তারা?
যারা অতিরিক্ত পরিস্কার পরিছন্ন থাকতে চায়, বেশ গোছালো, অনেক সময় নিয়ে কোন জিনিস পরিষ্কার করে অথবা গুছায়, সব কিছু একদম পারফেক্টলি হতে হবে এবং তা না হলে তারা বেশ অস্বস্তি তে ভোগে, বার বার চেক করেন একটা কাজ ঠিক মত হয়েছে কিনা – এদের কে আমরা সাধারণত শুচিবাই বলে থাকি। পরিষ্কার পরিছন্ন থাকা বা একটা কাজ গুছিয়ে করার চেষ্টা করা অবশ্যই কল্যাণকর কিন্তু যতক্ষণ তা মাত্রাতিরিক্ত না হয়ে যায়। যখন এই বিষয়টি মাত্রাতিরিক্ত হয়ে যাচ্ছে তখন নিজের কাজেরও যেমন ব্যাঘাত ঘটে তেমনি আসে পাশের মানুষ ও খেয়াল করে। কখনও কখনও পরিবারের/কাছের মানুষজন বিরক্তিও প্রকাশ করে থাকে। মনোবিজ্ঞান এর ভাষায় এই অবস্থা কে একটি রোগ বলা হয়ে থাকে – যার নাম অবসেসিভ-কম্পালসিভ ডিসঅর্ডার (ও সি ডি)। বাংলায় শুচিবায়ু রোগ বলা হয়ে থাকে।
ও সি ডিঃ ও সি ডি একটি মানসিক রোগ যেটাতে মানুষের মাথায় অনাকাঙ্ক্ষিত, অস্বস্তিকর চিন্তা, ছবি অথবা সন্দেহ আসে এবং যার পরিপ্রেক্ষিতে মানুষ মাত্রাতিরিক্ত, অপ্রয়োজনীয় কিছু কাজ বার বার করে থাকে। এই ধরণের চিন্তা/ছবি/সন্দেহ, যা মানুষটি ইচ্ছা করে মাথায় আনে না তবুও চলে আসে, – একে অবসেশন বলা হয়। আর যেই কাজ গুলো মানুষ অপ্রয়োজনীয় ও অতিরিক্ত জানার পরেও বার বার করে এবং থামাতে পারে না, সেগুলো কে কম্পালশান বলা হয়।
অবসেশনঃ সাধারণত যেসব বিষয়ে অবসেশনাল চিন্তা, ছবি বা সন্দেহ এসে থাকে –
-জীবাণু ও সংক্রমণের ভয়;
-যৌন বিষয়ে বিভিন্ন ধরণের চিন্তা;
-ধর্ম নিয়ে বিভিন্ন ধরণের চিন্তা, সন্দেহ বা ভয়;
-কারো ক্ষতি করে ফেলার ভয়, সন্দেহ বা অপ্রয়োজনীয় দায়িত্ববোধ;
-সব কিছু পারফেক্ট করে করতে হবে বা হতে হবে এই ধরণের চিন্তাধারা ইত্যাদি।
সাধারণত আমাদের সবারই এইধরনের চিন্তা ভাবনা অথবা অন্যান্য বিষয়ে অনাকাঙ্ক্ষিতভাবে কোন চিন্তা ভাবনা মাথায় এসে থাকে, যেটা অতটা অস্বস্তি তৈরি করে না। কারণ আমরা বিষয়টিকে এতটা গুরুত্ব দেই না বা সেটা নিয়ে বার বার ভাবি না। যাদের ও সি ডি আছে তারা এই বিষয়গুলোকে হাল্কা ভাবে নিতে পারে না, বরং বিষয়টিতে মনোযোগ দেয় এবং বার বার ভাবতে থাকে যার ফলে অস্বস্তি বাড়ে, অবসেশন চলতে থাকে।
কম্পালশানঃ যাদের ও সি ডি থাকে তারা সাধারণত যেসকল কল্পালসিভ কাজ করে থাকে –
-মাত্রাতিরিক্ত হাত ধোঁয়া বা পরিষ্কার রাখা
-জিনিসপত্র একটি নির্দিষ্টভাবে, নির্দিষ্টস্থানে সব সময় সাজিয়ে রাখা
-বার বার কিছু পরীক্ষা করে দেখা যেমন তালা ঠিক মত লাগান হয়েছে কিনা বা চুলা বন্ধ কিনা ইত্যাদি। এটি নিজের নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যায়।
-একটি কাজ পারফেক্টলি করার জন্যে বার বার করে যেমনঃ নামাজ অথবা ওযু করা।
অবশ্যই মনে রাখতে হবে, এইধরণের কাজ দুই তিন বার করে করা মানেই ও সি ডি নয়। আমরা সাধারণত কিছু কাজ দুই বার করে পরীক্ষা করে দেখে থাকি যেমন দরজা ঠিক মত লাগলো কিনা, তালা ঠিক মত লাগলো কিনা অথবা বাড়ী থেকে বের হওয়ার সময় চুলা বন্ধ করেছি কিনা ইত্যাদি। যদি এই কাজ গুলো অনিয়ন্ত্রিতভাবে মাত্রাতিরিক্ত হয়ে যায় এবং তা অবসেশন দ্বারা চালিত হয়, তাহলে আমরা বলতে পারি কারো ও সি ডি আছে।
একটি মানুষ ময়লা এরিয়ে চলে, পরিষ্কার পরিচ্ছন থাকে বা সব কাজ ঠিক মত গুছিয়ে করে বলেই যেমন “তার ও সি ডি আছে” বলা যাবে না আবার কেও এই কাজগুলো মাত্রাতিরিক্ত হারে করে এবং তার মধ্যে ও সি ডি এর অন্যান্য লক্ষণসমূহ থাকা সত্ত্বেও তাকে শুধুমাত্র “শুচিবায়ু” বলা বিপদজনক হতে পারে। এরকমটি হলে উপযুক্ত চিকিৎসা সেবা নেওয়া বাঞ্ছনীয়।
ও সি ডি এর লক্ষণ গুলো কারো মধ্যে অল্প মাত্রায় আবার কারো মধ্যে খুব বেশি মাত্রায় থাকতে পারে। কারো মধ্যে একটানা এই রোগ থাকতে পারে আবার কারো মধ্যে কয়কদিন পর পর আসতে পারে। এটি সাধারণত একটি দীর্ঘমেয়াদী রোগ। কারো সাথে যদি এই রোগ এর লক্ষণ গুলো মিলে যায় এবং তার অবসেশন-কম্পালশান গুলো যদি তার দৈনন্দিন জীবনযাপনের অন্যান্য কাজ গুলো কে ব্যাঘাত ঘটাতে শুরু করে – তবে অবশ্যই একজন অভিজ্ঞ মনরোগ বিশেষজ্ঞ (সাইকিয়াট্রিস্ট) অথবা ক্লিনিক্যাল সাইকোলজিস্ট এর সাথে যোগাযোগ করা আবশ্যক।
কারো কারো মধ্যে অবসেশন গুলো এতো তীব্র মাত্রায় আসতে পারে যে ঔষধ এর মাধ্যমে তা নিয়ন্ত্রন করার প্রয়োজন হতে পারে। সেক্ষেত্রে একজন সাইকিয়াট্রিস্ট সাহায্য করতে পারেন। আবার যেহেতু এটি ডায়বেটিস এর মত একটি জীবনব্যাপী দীর্ঘমেয়াদী রোগ, এটি কে ব্যবস্থাপনার মধ্যে রেখে ভালভাবে জীবনযাপন করা যায়। এক্ষেত্রে একজন ক্লিনিক্যাল সাইকলজিস্ট সাহায্য করতে পারে। সাধারণত দুই ধরণের চিকিৎসাই প্রয়োজন হয়ে থাকে। এই রোগ কেনো হয় এর পিছনে অনেক ধরণের তাত্ত্বিক ব্যাখ্যা রয়েছে। আপনার ক্ষেত্রে কীভাবে তৈরি ও শুরু হলো সে বিষয়ে জানতে পারবেন অভিজ্ঞ চিকিৎসক এর সাথে পরামর্শের মাধ্যমে।
মনে রাখতে হবে, ও সি ডি শুধুমাত্র একটি রোগ যেটি উপযুক্ত চিকিৎসার মাধ্যমে নিয়ন্ত্রনে রাখা যায়। কারো ও সি ডি থাকা মানেই এই নয় যে সে একজন পাগল। মানসিক রোগ থাকা মানেই পাগল নয়।
References:
Diagnostic and Statistical Manual of Mental Disorders, 5th Edition (DSM 5), 2013
Obsessive-Compulsive Disorder. National Institute of Mental Health. Retrieved from – https://www.nimh.nih.gov/health/topics/obsessive-compulsive-disorder-ocd/index.shtml
Powell, G. and Lindsay, S. (2007). The Handbook of Clinical Adult Psychology (3rd Ed.). Madison Ave, New York.