আমরা প্রত্যেকেই জীবনের কোন না কোন সময়ে কম বেশি বিষণ্ণতায় ভুগি। বিষণ্ণতা আমাদের জীবনের সাথে
ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে থাকলেও বিষণ্ণতা থেকে বেড়িয়ে এসে স্বাভাবিকভাবে বেঁচে থাকা অতিব প্রয়োজন।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা একটি পরিসংখ্যানে প্রকাশ করে যে, উচ্চ আয়ের দেশে বসবাসরত প্রায় ১৫ শতাংশ
মানুষ তাদের জীবদ্দশায় বিষণ্ণতা বা হতাশা অনুভব করে।
বিষণ্ণতা সম্পর্কে একটি ভুল ধারণা হলো, এটি মেজাজ নিয়ন্ত্রক নিউরোট্রান্সমিটার সেরোটোনিনের কম
নিঃসরণের ফলে হয়ে থাকে। যদিও এটি সত্য যে, ডিপ্রেসিভ ডিজঅর্ডার অনেক সময়েই সেরোটোনিন লেভেলের
স্বল্পতার সাথে সম্পর্কিত, তারপরেও বিষণ্ণতার জন্য সেরোটোনিনের মাত্রাকে একমাত্র কারণ হিসেবে না
ধরাই শ্রেয়।
দুর্ভাগ্যবশত, এই বিষণ্ণতা ও বিষণ্ণতাজনিত অন্যান্য সমস্যার জন্য চিকিৎসা শিল্প একটি সহজ সমাধানে
পৌঁছেছে, যা এসএসআরআইএস(SSRIs) সহ অন্যান্য এন্টি ডিপ্রেসেন্ট মেডিকেশনের ব্যবহার মহামারি
আকারে বৃদ্ধি করেছে।
যদিও এন্টি ডিপ্রেসেন্টগুলো এখনো চিকিৎসা ক্ষেত্রে ব্যাপক হারে ব্যবহৃত হচ্ছে, সাম্প্রতিক একটি
স্বাধীন মেটা-বিশ্লেষণে দেখানো হয় যে, ফার্মাসিউটিক্যাল ইন্টারভেনশনের ক্ষেত্রে প্লাসেবো এর প্রভাব
প্রায় ৮০ শতাংশ বেশি।
অর্থাৎ কোন ওষুধ সত্যি সত্যি গ্রহণ করার চেয়ে এটা বিশ্বাস করা প্রায় ৮০ শতাংশ কার্যকরী যে, যা
গ্রহণ করা হচ্ছে তা অবশ্যই আমার সমস্যা বা রোগ দূর করবে।
[প্লাসেবো হচ্ছে এমন এক চিকিৎসা ব্যবস্থা, যেটাতে ব্যক্তি মনে করে যে প্রয়োজনীয় ওষুধ ইনজেকশন
আকারে বা অন্য যে কোনভাবে তার শরীরে প্রবেশ করার ফলে সে ইতিবাচক পরিবর্তন লক্ষ্য করতে পারবে,
কিন্তু প্রকৃতপক্ষে ব্যক্তিকে কোন ওষুধ প্রয়োগ না করেই শুধুমাত্র এই বিশ্বাস তার মধ্যে স্থাপন করা হয়
যে আসলেই তার শরীরে তার রোগ নিরাময়কারী ওষুধ প্রয়োগ করা হয়েছে। এসব ক্ষেত্রে ফলাফল অনেকটাই
আশাব্যঞ্জক হয়ে থাকে।]
এর মাধ্যমেই আমরা বুঝতে পারি যে, ইতিবাচক চিন্তাভাবনা বা অনুভূতি যেমন বিষণ্ণতা মোকাবেলা করতে পারে
ঠিক তেমনি নেতিবাচক চিন্তাভাবনা বা অনুভূতি বিষণ্ণতা বৃদ্ধি করতে পারে।
প্রশান্ত মন, আত্মতৃপ্তি এবং সুস্থতা বজায় রাখার জন্য কিছু সহজ, শক্তিশালী, দৈনন্দিন পদক্ষেপগুলো নিম্নে
দেয়া হলো:
১. প্রিয় বন্ধুর সাথে কথা বলুন অথবা কাউকে সাহায্য করুন :
সবসময় মানুষের কাছাকাছি থাকার একটি শক্তিশালী ইতিবাচক প্রভাব রয়েছে। বিচ্ছিন্নতার ফলে আমাদের
মধ্যে যে সংকীর্ণতা বিষণ্ণতার সৃষ্টি হয় তা অনেকটাই প্রতিহত হয় সকলের সাথে মিলেমিশে সময় কাটালে।
ছোটবেলা থেকে যদি পারিবারিক বন্ধন তৈরিতে ঘাটতি থাকে তবে পরবর্তীতে তা ব্যক্তির মধ্যে বিষণ্ণতা
সৃষ্টি করতে পারে, যা আমাদের দেহে সেরোটোনিন (মেজাজ), ডোপামিন ( সুরক্ষা, সুস্থতা) এবং অক্সিটোসিন
(বন্ধন /এটাচমেন্ট) এর মাত্রা কমিয়ে দেয়।
আপনার যে বন্ধুটি আপনাকে সবচেয়ে ভালো বোঝে তার সাথে সময় কাটান, তাহলে দেখবেন আপনার মন
স্বাভাবিকভাবেই প্রফুল্ল হয়ে উঠবে।
বিভিন্নরকম সেবামূলক কাজ আমাদের ফ্রন্টাল কর্টেক্সের বিভিন্ন লোবগুলোকে উদ্দীপিত করে এবং মেজাজ
স্থিতিশীল করতে সহায়তা করে।
২. নিয়মিত হাঁটার অভ্যাস গড়ে তুলুন:
গবেষণায় দেখা যায়, নিয়মিত হাঁটার ফলে অক্সিটোসিন নিঃসরণের হার বৃদ্ধি পায়। অক্সিটোসিন হলো এমন
একটি হরমোন যা ভালোবাসা, আবেগ ইত্যাদির উদ্রেক ঘটায় এবং এটি জন্মদানের সময় নিঃসৃত হওয়া
অত্যান্ত গুরুত্বপূর্ণ হরমোন। অল্প স্বল্প ব্যায়াম আমাদের মস্তিষ্ককে পরিষ্কার রাখে,মস্তিষ্কে
অক্সিজেন প্রবাহ স্বাভাবিক রাখে এমনকি সেরোটোনিন নিঃসরণকে অনেকাংশে উদ্দীপিত করে।
#১ নম্বরের সাথে এটির সংযোজন করুণ, তাহলে দেখতে পাবেন দ্বিগুণ ফল পাচ্ছেন।
৩. তালিকা তৈরি করুন :
নেতিবাচক চিন্তাভাবনা গুলো ধাপে ধাপে আমাদের অযৌক্তিক সংকীর্ণতা ও কম আত্মসম্মানের দিকে ধাবিত
করে, ঠিক যেমনটা কোন আঘাতের পরে শরীরের মধ্যে দীর্ঘস্থায়ী ব্যাথা থেকে যায়।
নেতিবাচক চিন্তাভাবনা বা অনুভূতিগুলোকে দূর করার জন্য আমরা দুটি উপায় অবলম্বন করতে পারি:
● অন্যরা আপনার যে ৫টি বিষয় ভালোবাসে তার একটি তালিকা তৈরি করুন।
● যে জিনিস,ব্যক্তি বা ঘটনা আপনার জীবনে কোন কাজেই আসেনা অথবা আপনার জীবনে তাদের
অস্তিত্ব কোন ভূমিকাই রাখেনা, সেই জিনিস,ব্যক্তি বা ঘটনাগুলোর লিস্ট করুন এবং আপনার জীবন
থেকে সেগুলো ঝেড়ে ফেলুন।
৪. মেডিটেশন :
প্রতিদিন কয়েক মিনিট পেট থেকে গভীর শ্বাস নিয়ে ৮সেকেন্ডের জন্য ভেতরে রেখে তা বাইরে ছেড়ে দিলে
আপনার দেহ ও মনের জন্য এটি একটি শক্তিশালী এজেন্ট হিসেবে কাজ করবে। যখন আপনার শরীর
প্রয়োজনীয় অক্সিজেন পায়না তখন আপনার রক্তের মধ্যে ক্ষতিকর গ্যাসগুলো বেড়ে যায়। স্নায়ুতন্ত্রের
উদ্বেগ এবং ফাইট অর ফ্লাইট প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি হয়।
দ্বিতীয়ত, যথাযথ অক্সিজেনেশন ছাড়া আপনার মস্তিষ্কে রক্তসঞ্চালন সঠিকভাবে হয়না এবং মস্তিষ্কের
কর্মক্ষমতাও হ্রাস পায়।
ডিপ ব্রিথিং অথবা মেডিটেশন আমাদের হার্ট রেট ধীর ও স্বাভাবিক রাখে, মস্তিষ্কে রক্ত প্রবাহ পুনরুদ্ধার
করে এবং আপনার স্নায়ুতন্ত্রকে শান্ত করে।
৫. আপনার রক্তের শর্করা স্থির রাখুন / মাছের তেল এবং উদ্ভিজ্জ তেল( EFAs) গ্রহণ করুন:
বিষণ্ণতা আপনার শরীরে সেরোটোনিনের মাত্রা এমনভাবে পরিচালনা করতে পারে যা আপনার ইমোশনাল /
স্ট্রেস ইটিং প্যাটর্ন( সাধারণ কার্বাইড, চিনি, অ্যালকোহল) এবং আসক্তি, অতিরিক্ত নিদ্রা ইত্যাদি বৃদ্ধি
করতে পারে।
নিশ্চিত করুন যে, আপনি প্রতি তিন ঘণ্টায় অল্প পরিমাণ হলেও কিছু খাচ্ছেন কিনা। এতে আপনি হাইড্রেটেড
থাকতে পারবেন, যা আপনার ফাইট অর ফ্লাইট বা রক্তে শর্করার মাত্রা নিয়ন্ত্রণ করবে।
এটি ক্লিনিক্যালি প্রমাণিত যে, ৩-৪গ্রাম EFAs( ওমেগা ৩,৬,৯) গ্রহণ করা অনেকটা ডিপ ব্রিথিং এর মত যা
আপনার মস্তিষ্কের আদর্শ কার্যাবলীকে পুনঃস্থাপন করে, বিশেষত এমন এলাকায় যেখানে অযৌক্তিক
চিন্তাভাবনা বা অনুভূতিগুলোকে দূর করতে পারে।
এই প্রভাবগুলো অনুভব করতে হয়তো একটু সময় লাগতে পারে, যেমন ব্যায়ামের ফলে আপনি ধাপে ধাপে ভালো
বোধ করতে শুরু করেন এবং ইতিবাচক জিনিসগুলো বেশি বেশি করার মাধ্যমে নেতিবাচক সবকিছুকে এড়িয়ে
যাওয়ার চেষ্টা করেন।