আমেরিকান সাইকোলজিক্যাল এসোসিয়েশন (APA,১৯৮৭) এর মতে ট্রমা হচ্ছে এক ধরনের প্রতিক্রিয়া যা মানুষের তীব্র মানসিক চাপমুলক পরিস্থিতিতে ঘটে থাকে। এই ধরনের মানসিক চাপমুলক পরিস্থিতিগুলো সাধারণত মানুষ সচারচর সম্মুখিন হয়ে থাকেন না। আর এই পরিস্থিতিতিগুলোতে সাধারণত যেকোন মানুষের ক্ষেত্রেই খুব তীব্র মাত্রায় শক বা মানসিক আঘাত পেয়ে থাকেন। এই পরিস্থিতিগুলোতে মানুষের মৃত্যু ঝুকি থাকে অথবা তীব্র মাত্রায় কোন আঘাত থাকে অথবা সম্ভাবনা থাকে এবং এগুলো ব্যক্তি হয়তো নিজে শিকার হয়ে থাকেন অথবা তিনি সরাসরি প্রত্যক্ষ করে থাকেন। এরকম ট্রমাটিক ঘটনাগুলোর মধ্যে রয়েছে যেমন, নিজের চোখের সামনে কারো মর্মান্তিক মৃত্যু ঘটতে দেখা, যেকোন ধরনের মারাত্মক দুর্ঘটনা এর সম্মুখিন হওয়া, ধর্ষনের শিকার হওয়া, যেকোন ধরনের প্রাকৃতিক দুর্যোগ, অগ্নি দুর্ঘটনা, ভুমিকম্প ইত্যাদির শিকার হওয়া অথবা অন্য কেউ শিকার হচ্ছে তা সরাসরি প্রত্যক্ষ করা।
এই ধরনের ঘটনাগুলোতে মানুষ তীব্র মাত্রায় ভয় পেয়ে থাকেন, সে নিজেকে অসহায় মনে করতে থাকেন অথবা আতঙ্কগ্রস্থ থাকেন। কোন ধরনের ট্রমাটিক ঘটনা ঘটে যাওয়ার পরে ব্যক্তির মধ্যে নানা ধরনের মানসিক সমস্যার লক্ষণ দেখা যায়। যা পরবর্তিতে পোষ্ট-ট্রমাটিক স্ট্রেস ডিসঅর্ডার বা (PTSD) তে পরিনত হয়। অনেক সময় ট্রমার ঘটনাগুলো অনেক তীব্র না হলেও, অনেক গুলো ছোট ছোট ট্রমার ঘটনা যা দীর্ঘ দিন ধরে ঘটে আসছে সেগুলো ধীরে ধীরে পোষ্ট-ট্রমাটিক স্ট্রেস ডিসঅর্ডারে পরিনত হয়ে থাকে। উদাহরণস্বরুপ বলা যায়, কোন একটি মেয়ে দীর্ঘদিন ধরে তার কাছের কোন মানুষের কাছ থেকে যৌন নির্যাতনের শিকার হয়ে আসছে যা একসময় এসে পোস্ট-ট্রমাটিক স্ট্রেস ডিসঅর্ডারে পরিনত হতে পারে।
বাংলাদেশে বিভিন্ন সময়ে নানা ধরনের ট্রমাটিক ঘটনা ঘটে থাকে এদের মধ্যে উল্যেখযোগ্য কিছু ঘটনা হচ্ছে সাভারের রানা প্লাজার ধসের ঘটনা যেখানে প্রায় কয়েক হাজার মানুষ মারা যায়, একটি গবেষণায় দেখা গেছে রানা প্লাজায় ক্ষতিগ্রস্থ শ্রমিকদের মধ্যে শতকরা প্রায় ৭৫.৬৯% শ্রমিক PTSD এর শিকার হয়েছেন। এরকম আরো কিছু ঘটনা রয়েছে যেমন, তাজরিন ফ্যাশন পোশাক কারখানায় অগ্নিকান্ড যেখানে প্রায় কয়েকশো মানুশ আগুনে পুড়ে মারা যান, সেখান থেকে যারা বেঁচে ফিরে আসেন তাদের অনেকেরই মধ্যে PTSD রয়েছে। সাম্প্রতি সময়ে কিছু ঘটনা যেমন, পুরান ঢাকার চকবাজারের অগ্নিকান্ড, বনানীতে অগ্নিকান্ড. এই ধরনের ঘটনার শিকার অনেকেই PTSD তে ভুগছেন। এছাড়াও প্রতিনিয়ত বাংলাদেশে বহু ধর্ষনের ঘটনা ঘটছে যা PTSD হওয়ার ক্ষেত্রে অন্যতম একটি কারণ।
PTSD এর লক্ষণ সমূহ:
১. ব্যক্তির মধ্যে ট্রমাটিক ঘটনার সম্পর্কিত ছবি, চিন্তা এবং অনুভুতিগুলো বার বার তার মনের মধ্যে আসতে থাকবে।
২. সে ট্রমার ঘটনাগুলো নিয়ে বার বার দু:স্বপ্ন দেখতে থাকবে।
৩. তার ট্রমার স্মৃতি নিয়ে বার বার নানা ধরনের ইলুশন, হ্যালুসিনেশন, এবং ফ্লাসব্যাক হতে থাকবে। যা তাকে তীব্র মানসিক অস্বস্থি প্রদান করবে।
৪. ব্যক্তি সব সময় তার ট্রমা সম্পর্কিত কোন চিন্তা, এবং অনুভুতিগুলোকে এড়িয়ে যাওয়ার চেষ্টা করবে, এমনকি কেউ যদি এই ঘটনা সম্পর্কিত কোন কথা বলে তাহলে তিনি তা এড়িয়ে যাবেন।
৫. কোন কাজ, স্থান অথবা কোন মানুষ যা তার ট্রমার স্মৃতিকে ট্রিগার করে তিনি সেগুলোকেও এড়িয়ে যাবেন।
৬. তিনি তার ট্রমার ঘটনার কোন গুরুত্ব্পূর্ণ বিষয়কে মনে করতে পারবেন না।
৭. তিনি নিজের জগতটাকে গুটিয়ে নিয়ে আসেন এবং তিনি অন্যদের কাছ থেকেও নিজেকে আলাদা করে ফেলেন।
৮. ব্যক্তি তার বর্তমানের সাথে ট্রমার ঘটনাটিকে আলাদা করতে পারেন না, তাই ট্রমার ঘটনার সাথে সম্পর্কিত যেকোন বিষয় তাকে ট্রিগার করে থাকে এবং তিনি সেগুলোকে এড়িয়ে যান।
৯. এছাড়ার তাদের মধ্যে আরো কিছু লক্ষণ দেখা যায় যেমন, ঘুম কমে যায়, যেকোন বিষয়ে খুব রেগে যায়, মনযোগ দিতে সমস্যা হয়, যেকোন বিষয়ে অতি মাত্রায় সতর্কতা প্রদর্শন করেন, এবং তাদের মধ্যে অনেক বেশি অপরাধবোধ কাজ করে থাকে ইত্যাদি।
পোষ্ট-ট্রমাটিক স্ট্রেস ডিসঅর্ডার এর চিকিৎসা:
PTSD এর চিকিৎসা বেশ কয়েকটা ধাপে হয়ে থাকে। প্রাথমিকভাবে ব্যক্তির কোন ধরনের শারীরিক সমস্যা থাকলে, যেমন কোন ধরনের ইনজুরি অথবা আঘাত থাকলে জরুরী ভিত্তিতে রোগীকে নিয়ে ডাক্তারের সরনাপন্ন হওয়া এবং চিকিৎসা সেবা নেওয়া। এর পাশাপাশি ব্যক্তির নিরাপত্তার ব্যবস্থা নিশ্চিত করা। অনেক সময় ব্যক্তি নানা বিষয়ে ঝুঁকির মধ্যে থাকেন, যেমন, কেউ যৌন নির্যাতনের শিকার হলে, পরবর্তিতে যাতে সে কোন ধরনের যৌন নির্যাতনের শিকার না হয় সেজন্য তার জন্য একটা নিরাপদ পরিবেশ নিশ্চিত করা। নিরাপত্তা নিশ্চিত করার জন্য ব্যক্তির পরিবেশ এমন ভাবে প্রস্তুত করা যাতে সে পরিবেশটাকে নিরাপদ মনে করে, অথবা নিরাপত্তার জন্য প্রশাসনের অথবা কোন আইন প্রয়োগকারী কোন সংস্থার সহায়তা নেওয়া।
পরবর্তিতে ব্যক্তির মানসিক সমস্যাগুলো নিয়ে কাজ করার জন্য কোন সাইকিয়াট্রিস্ট অথবা কোন ক্লিনিক্যাল সাইকোলজিস্ট এর শরণাপন্ন হওয়া। কোন প্রশিক্ষিত সাইকোলজিস্ট অথবা ক্লিনিক্যাল সাইকোলজিস্ট এর কাছে নিয়মিত সাইকোথেরাপি নেওয়া। নিয়মিত সাইকোথেরাপি নিলে ব্যক্তির মধ্যে সমস্যাগুলো অনেকাংশে কমে আসে এবং অধিকাংশ ক্ষেত্রেই রোগীরা পুরোপুরি সুস্থ হয়ে যান। গবেষণায় দেখা যায় যে PTSD এর জন্য Exposure based Cognitive Behavior Therapy (CBT), Trauma Focused CBT, Eye Movement Desensitization and Reprocessing (EMDR) এ ধরনের সাইকোথেরাপিগুলো বেশ ভালো কাজ করে।
সর্বোপরি PTSD এর চিকিৎসা সাধারণত মাল্টি ডিসিপ্লিনারি পদ্ধতিতে চিকিৎসা করা হয়ে থাকে। যেখানে একজন ডাক্তার থেকে শুরু করে, সাইকিয়াট্রিস্ট, সাইকোলজিস্ট, ক্লিনিক্যাল সাইকোলজিস্ট, অকুপেশনাল থেরাপিস্ট, সোসাল ওয়ার্কার, নার্স, এবং আইনজীবী সবাই এক সাথে একটি সামগ্রিক প্রকৃয়ায় (Holistic Approac) কাজ করে থাকেন। এক্ষেত্রে এর সাথে সম্পর্কিত সকল পেশাজীবীদের সমন্বয় সাধনের মাধ্যমে কাজ করতে হবে। এজন্য তাদের মধ্যে সব সময় যোগাযোগ থাকতে হবে। নিয়মিত যোগাযোগ থাকলে কাজে সমন্বয় বেশ ভালো হয়। এজন্য পেশাজীবীদের মধ্যে যথাযথ রেফারেল সিস্টেম এর ব্যবস্থা থাকলে বেশ ভালো হয়l
লেখক
দীপন চন্দ্র সরকার
এসিস্ট্যাস্ট ক্লিনিক্যাল সাইকোলজিস্ট
এম ফিল গবেষক
ক্লিনিক্যাল সাইকোলজি বিভাগ
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।
রেফারেন্স:
Diagnostic and Statistical Manual of Mental Disorders, 5th Edition (DSM 5), 2013
Powell, G. and Lindsay, S. (2007). The Handbook of Clinical Adult Psychology (3rd Ed.). Madison Ave, New York.
Post-Traumatic Stress Disorder. National Institute of Mental Health (NIMH). Retrived From- https://www.nimh.nih.gov/health/topics/post-traumatic-stress-disorder-ptsd/index.shtml
Fitch, T., Villanueva, G., Quadir, M., & Alamgir, H. (2015). Prevalence and risk factors for PTSD in injured workers in Bangladesh: a study of surviving workers from the Rana Plaza building collapse. The Lancet Global Health, 3, S33.