বর্তমান সময়ে আমরা সচরাচর যে শব্দগুলো সর্বাধিক ব্যবহার করে থাকি তার মাঝে বিষন্নতা, হতাশা বা ডিপ্রেশন অন্যতম। আমরা অনেকেই প্রকৃতঅর্থেই ডিপ্রেশনে আক্রান্ত হই। আবার অনেকে মন খারাপ কে ডিপ্রেশন বলে প্রকাশ করি। যদিও মন খারাপ এবং ডিপ্রেশন এর মধ্যে অনেক তফাৎ রয়েছে। মন খারাপ একবেলা বা অল্প সময়ের জন্য হতে পারে। তবে বিষণ্নতা বা ডিপ্রেশন একটি মানসিক রোগ যা দীর্ঘ দিনের ব্যবধানে মানুষের মাঝে পরিলক্ষিত হয়। আমাদের জীবনের যেকোনো সময়, যেকোনো মুহূর্তে, যে কোনো অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে বিষন্নতা গ্রাস করতে পারে। আমাদের মধ্যে যারা পেশাদার জীবন বা চাকরি জীবনে সময় অতিবাহিত করছেন তাদের কেও বিষণ্নতা গ্রাস করতে পারে। নানা কারণে একজন চাকরিজীবী বিষণ্নতায় আক্রান্ত হতে পারেন। আজকের ব্লগে আমরা একজন চাকুরীজীবি মানুষের জীবনে পেশাগত বিষয় গুলোর কারণে কিভাবে বিষন্নতা আসতে পারে এবং কিভাবে এই বিষন্নতা থেকে মুক্ত হওয়া যায় তা নিয়ে জানার চেষ্টা করব।

 

 

সহকর্মীঃ

সহকর্মী বলতে আমরা সেই সকল মানুষদেরকে বুঝি যারা কোন একটি কর্মক্ষেত্রে একসাথে কাজ করে। তবে একই কর্মক্ষেত্রের কাজ করলেও আমাদের বিভিন্ন ধরনের সহকর্মী থাকতে পারে। যেমন কেউ হয়ত আপনার খুবই ঘনিষ্ঠ, কারো সাথে হয়তো আপনার পূর্বের পরিচয় ছিল, কেউ হয়তো আপনার নিজের আবার কেউ হয়তো অন্য ডিপার্টমেন্টের সহকর্মী। চাকরি জীবনের বা পেশাগত কর্মক্ষেত্রে বিষন্নতার কারণ বা দূর করার উপায় বের করার জন্য সহকর্মীদের সম্পর্কে জানা খুবই জরুরী।

বিষন্নতার সম্পর্কে বোঝার জন্য চলুন আমরা কর্মক্ষেত্রের তিন ধরনের সহকর্মীর কর্মক্ষেত্রে অবস্থা সম্পর্কে বিশ্লেষণ করি।

জনাব আরিফ, শফিক এবং জিনিয়া সনামধন্য একটি বেসরকারী প্রতিষ্ঠানের মার্কেটিং ডিপার্টমেন্ট কর্মরত আছেন।

 

 

০১/ জনাব আরিফ (দক্ষ- চাপা স্বভাবের- বিচক্ষণ)ঃ

মার্কেটিং ডিপার্টমেন্ট অন্য সকল কর্মকর্তাদের চাইতে, জনাব আরিফের প্রোফাইল সবচেয়ে বেশি সমৃদ্ধ। তার যেমন সফট স্কিল রয়েছে ঠিক তেমনি রয়েছে নেতৃত্বের গুণাবলী। তবে কর্মক্ষেত্র বিভিন্ন অস্বাস্থ্যকর রাজনীতি এবং কিছু ক্ষেত্রে দুর্নীতি তাকে বেশ মানসিক চাপ ও হতাশাগ্রস্ত করছে। কিন্তু বিচক্ষণ হওয়ার বদৌলতে ও নিজের মান সম্মান বাঁচিয়ে চলার স্বার্থে তিনি এই বিষয়গুলো নিয়ে তার সহকর্মীদের সাথে খুব একটা আলোচনা করেন না। একপ্রকার বলতে পারেন তিনি তার কর্মক্ষেত্রের কাউকে এ ব্যাপারে খুব একটা বিশ্বাস করতে পারেন না। ফলশ্রুতিতে তিনি অফিসের কোনো কাজেই তার শতভাগ দিয়ে সফলতা অর্জন করতে পারছেন না। যার ফলে তার বিষণ্নতা বেড়েই চলেছে। পরিবার এবং প্রিয়জনের সাথে এসব বিষয়ে আলোচনা করলেও, যেহেতু তারা তার অফিসের কালচার বা সংস্কৃতি সম্পর্কে জানেনা তাই তাদের বলে খুব একটা উপকার পান না তিনি। একটা সময়ে এসে অনেকটা অপারগ হয়ে তাকে চাকরি থেকে অব্যাহতি নিতে হয়।

 

০২/ জনাব শফিক (বন্ধুসুলভ- ঠোঁট পাতলা -অতিরিক্ত অভিযোগ করেন)ঃ

জনাব শফিক ব্যক্তি হিসেবে খুবই বন্ধুসুলভ। তিনি খুব সহজেই যে কারো সাথে মিশে যেতে পারেন। তিনি খুবই ঠোঁট পতলা প্রকৃতির মানুষ অর্থাৎ তাঁর কোনো কথাই তিনি গোপন রাখতে পারেন না। অফিসে কোনো বিষয় তার কাছে খারাপ লাগলে কিংবা তিনি কোনো বিষয় নিয়ে বিরক্ত হলে বা বিষণ্ণতায় ভুগে সবার সাথে সেটি শেয়ার করা শুরু করেন। সবাই তার কথা শুনলেও, আড়ালে সবাই তাকে নিয়ে হাসি ঠাট্টা করে। যার ফলে কর্মক্ষেত্র তিনি বন্ধুসুলভ হলেও, অফিসে তার প্রস্পেক্ট বা মূল্য খুব একটা ভালো নয়।

 

০৩/ মিসেস জিনিয়া (আবেগপ্রবণ- বন্ধুসুলভ- সিদ্ধান্তহীনতা)ঃ

মিসেস জিনিয়া ব্যক্তি হিসেবে খুবই আবেগপ্রবণ ও দোদুল্যমান একজন মানুষ। তিনি সহজে যেমন কোনো বিষয়ে দুঃখ পান, তেমনি ছোট ছোট বিষয়গুলো তাকে খুব আনন্দিত করে। যার ফলে যে কেউ তাকে অনাকাঙ্ক্ষিত ভাবে কষ্ট দিলেও খুব সহজেই সেটা আবার ভুলিয়ে ফেলা যায়। তাকে তার এই আবেগপ্রবণতার সুযোগ নিয়ে তার কর্মক্ষেত্রের অসাধু এক সহকর্মী প্রতিনিয়তই তার সাথে অনাকাঙ্ক্ষিত ও ঘৃণিত কাজ করতে থাকে। জিনিয়া লোকচক্ষুর ভয়ে এবং নিজের সম্মানের দিকে তাকিয়ে তার সহকর্মীর এই অন্যয় আচরণ ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ ও অন্যান্য সহকর্মীদেরকে জানাতে ভয় পান এবং ইতঃস্তত বোধ করেন। তার এই অপারগতার সুযোগ নিয়ে সে অসৎ সহকর্মী তাকে ব্ল্যাকমেইল করতে থাকে। একটা সময়ে এসে মিসেস জিনিয়া আত্মহত্যার কথা ভাবেন।

 

 

সহকর্মীদের মনস্তান্তিক অবস্থা বিশ্লেষণঃ

 

  • জনাব আরিফ তার সমস্যার কথাগুলো সহকর্মীদের কাছে প্রকাশ করতে পারেননি।
  • জনাব শফিক তার সমস্যার কথাগুলো সহকর্মীদের সাথে সহজেই প্রকাশ করলেও গুরুত্ব হারিয়েছেন।
  • মিসেস জিনিয়া লোকচক্ষুর ভয়ে অপ্রীতিকর ঘটনা গুলো সবাইকে জানাতে পারেননি এবং সঠিক ব্যবস্থা গ্রহণ করতে পারেননি।

 

 

কর্মজীবনে কেন বিষন্নতা আসেঃ

 

আমাদের দৈনন্দিন জীবনের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ একটি অংশ হলো আমাদের কর্মজীবন। কর্মজীবনে বিভিন্ন কারণে হতাশা কিংবা বিষন্নতা আসতে পারে। কর্মক্ষেত্রে সফলতা অর্জনের জন্য বিষন্নতা কাটিয়ে ওঠা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। অবস্থা ও ব্যক্তিভেদে বিষন্নতার কারণ ভিন্ন হতে পারে। যেমন ,

 

  • চাকরি কে উপভোগ না করা,
  • কর্মক্ষেত্রের পেশাদারী পরিবেশে মানিয়ে নিতে না পারা,
  • সহকর্মীদের সাথে ভাল সম্পর্ক তৈরী না হওয়া,
  • অতিরিক্ত কাজের চাপ থাকা,
  • অস্বাস্থ্যকর অফিস পলিটিক্স এর শিকার হওয়া,
  • নিয়মিত বেতন না পাওয়া,
  • বিভিন্ন উৎসবে ছুটি না পাওয়া,
  • অফিসের সহকর্মী কিংবা উর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের দাঁড়া অপ্রীতিকর ঘটনার সম্মুখীন হওয়া ইত্যাদি উল্লেখযোগ্য।

 

সহকর্মীদের সাথে বিষণ্ণতার কথা বলার ব্যাপারে কোন বিষয়গুলো খেয়াল রাখা উচিৎঃ

 

০১/ অবশ্যই এমন সহকর্মীর সাথে আপনার বিষন্নতার কথা শেয়ার করুন, যাকে আপনি সবচেয়ে ভালো ভাবে চেনেন,

০২/ বিশ্বস্ত সহকর্মীর সাথে বিষন্নতা নিয়ে কথা বলুন,

০৩/ অভিজ্ঞ সহকর্মীদের সাথে কথা বলে তাদের অভিজ্ঞতাগুলো জানার চেষ্টা করুন,

০৪/ সম্ভব হলে সরাসরি নিজের বিষন্নতা কথা না বলে, বিচক্ষণতার সাথে সমস্যাগুলো সহকর্মীদের সাথে আলোচনা করুন,

০৫/ কখনোই কোন ঠোঁট পাতলা ব্যক্তি কে নিজের বিষন্নতার কথা সরাসরি বলবেন না,

০৬/ কর্মক্ষেত্রের সবার কাছে গণহারে নিজের বিষন্নতার কথা বলবেন না,

০৭/ কোনো একটি কাজে আপনি সফল না হলে কখনোই নিজের বিষণ্ণতাকে দায়ী করে, ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তার কাছে অজুহাত দিবেন না,

০৮/ সম্ভব হলে কোনো একজন সহকর্মীর সাথে ভালো বন্ধুত্ব তৈরী করুন,

০৯/ সম্ভব হলে অন্য সহকর্মীদের বিষন্নতার ব্যাপার গুলো আগে জানার চেষ্টা করুন।

 

 

সমাধানে যা করা উচিতঃ

 

০১/ কর্মক্ষেত্রের কালচার বা সংস্কৃতি বুঝার চেষ্টা করুন,

০২/ সম্ভব হলে কর্ম ক্ষেত্রে একজন ভালো বন্ধু তৈরি করুন,

০৩/ চেষ্টা করুন অন্যান্য সহকর্মীদের মনস্তাত্ত্বিক অবস্থা বুঝার। শুধু আপনি একাই  কর্মস্থলে বিষণ্নতায় ভুগছেন ব্যাপারটি তা নয়। আপনার মত অন্যান্য সহকর্মীরাও হয়তো একই বিষয়ে বিষণ্নতায় আছে। খুঁজে বের করুন আপনার মতন অন্য কে কে  বিষন্নতায় ভুগছে।

০৪/ কর্মক্ষেত্রে অতিরিক্ত চাপ নেবেন না,

০৫/ আপনি যে কাজটি পারবেন না, তা শুরুতেই না করে দিন,

০৬/ বাড়তি কিছু অর্থের আশায় দিনরাত অফিসে অযথা বাড়তি খাটনি করবেন না,

০৭/ সম্ভব হলে প্রতিদিন কিংবা সপ্তাহে একদিন প্রিয়জন ও বন্ধুদের সাথে সময় কাটান,

০৮/ সম্ভব হলে প্রতিদিন কিংবা সপ্তাহে একদিন বিনোদনের জন্য সময় বের করুন,

০৯/ অপ্রিতিকর কিছুর সম্মুখীন হলে, দ্রুত তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহন করুন,

১০/ যদি কর্মক্ষেত্রের কাজ আপনার পছন্দ না হয় তাহলে কর্মক্ষেত্র পরিবর্তনের চেষ্টা করুন।

 

 

কোনো কাজের ক্ষেত্রে আনন্দ অনুভব করা এবং সেই কাজের প্রতি আগ্রহ পাওয়াটা খুবই জরুরী। যদি কোনো কারণে কাজের প্রতি আপনার আগ্রহ হারিয়ে ফেলেন, তাহলে সেই কাজটি আপনার জন্য একটি বোঝা হয়ে দাঁড়াবে। দিনের পর দিন যখন একই একঘেয়ামি কাজ করতে থাকবেন তখন সেটি ধীরে ধীরে আপনার মানসিক স্বাস্থ্যের উপর প্রভাব ফেলা শুরু করবে। কর্মক্ষেত্রে কোনো অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনার সম্মুখীন হলে দৃঢ়তার সাথে সে সমস্যা মোকাবেলা করুন। কখনোই আবেগপ্রবণ হয়ে কোনো সমস্যাকে আড়াল করে রাখবেন না। কর্মক্ষেত্র আমাদের জীবনে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি স্থান। তাই এখানে নিজের সর্বোচ্চ অর্থাৎ শতভাগ দেওয়াটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। কর্মক্ষেত্র বা চাকরীর উপর যেমন আমরা নির্ভরশীল ঠিক তেমনি আমাদের পরিবার বা অধীনস্থরা নির্ভরশীল। তাই চেষ্টা করুন কর্মস্থল কে নিজের আনন্দপূর্ণ জায়গা হিসেবে তৈরি করে নিতে। তবে এ ব্যাপারে গুরুতর সমস্যার সম্মুখীন হলে যেকোনো কঠিন সিদ্ধান্ত নেওয়ার আগে অবশ্যই পরিবার পরামর্শ নিন এবং প্রয়োজন পড়লে চিকিৎসকের শরণাপন্ন হন।

Psycure

Scroll to Top