ক্ষুধা, তৃষ্ণা সহ অন্যন্য জৈবিক শারীরবৃত্তীয় চাহিদা গুলোর মতই যৌন চাহিদা স্বাভাবিক একটা চাহিদা আমাদের জীবনে। প্রতিটি প্রাণীর মধ্যেও যৌন চাহিদা লক্ষ্য করা যায়। মানব জাতীর অস্তিত্ব টিকে আছে একমাত্র যৌন চাহিদার জন্যই। আপনি আমি সবাই এই যৌন চাহিদার সামাজিক বহিঃপ্রকাশ এর ফলেই এ পৃথিবীর আলো বাতাস অবলোকন করতে পারতেছি এবং আমরা আমাদের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখার জন্য ও যৌন চাহিদার গুরুত্ব অনস্বীকার্য। এবং এটা আমাদের সবার জানা কথা। বাট আমাদের ধর্ম, সামাজিকতা, কৃষ্টি কালচারের দৃষ্টিভঙ্গির কারনে যৌনতা খুবই নেতিবাচক একটা ব্যাপার যেটা আমরা খোলা মেলা ভাবে আলোচনা করতে পারি না। অতি গোপনীয় একটা ব্যাপার। যৌনতা বিষয়টা আমাদের দেশে পাপ, লজ্জাকর, খারাপ, নোংরা অর্থাত নিষিদ্ধ এবং গোপনীয় হিসেবে দেখা হয়।
আর এ গোপনীয়তার সুযোগ নিয়ে যৌনতা নিয়ে একশ্রেণির মানুষ maltreated হচ্ছে। অধ্যবদি আমাদের দেশে যৌনতার মত গুরুত্বপূর্ণ বিষয় নিয়ে কোন প্রাতিষ্ঠানিক জ্ঞান অর্জনের সুযোগ নাই। কোন দিন হবে কিনা সন্দেহ আছে। যৌনতা নিয়ে বন্ধু বান্ধব, কবিরাজ, ফুটপাতের ক্যানভাসার, পর্নোগ্রাফী ছবি, বই, বাসের জানালা দিয়ে ছুড়ে মারা লিফলেট ইত্যাদির মাধ্যমে অপশিক্ষা লাভ করি।
যৌনতা নিয়ে এরকম suppression এর কারনেই আমি যদি বলি বাংলাদেশে ধর্ষনের সংখ্যা বাড়তেছে তাহলে অনেকেই একমত হবেন না বাট মনোবিজ্ঞানীদের মতে যেটা আমরা নেতিবাচকভাবে মনে অবদমিত করে রাখবো সেটা অন্যভাবে প্রকাশিত হবে।
যেহেতু আমাদের দেশে যৌনতা নিয়ে স্বাভাবিক আলোচনা হয় না তাই কারো কোন যৌন সমস্যা হলেও আমরা সেটা বুঝতেই পারি না। লুকিয়ে লুকিয়ে অপচিকিৎসা করে আরও খারাপ করে ফেলি। আমাদের সাধারণত ২ কারনে যৌন সমস্যা দেখা দেয়।
১. Primary sexual problems: এটা শারীরিক বা মেডিক্যাল সমস্যার কারনে হয়ে থাকে যেটার জন্য ডাক্তারের শরণাপন্ন হতে হয়। যেমন STD, STI ইত্যাদি।
২. Secondary sexual Problem: নন মেডিক্যাল বা মানসিক কারনে এ সমস্যা হয়ে যায়। বাংলাদেশে বেশীরভাগ যৌন সমস্যা হল Secondary sexual problems. মনোবিজ্ঞানের ভাষায় এটাকে মনোঃযৌন সমস্যা বা Psychosexual dysfunction (PSD) বলা হয়। আর এটার অন্যতম একটা কারন হলো যৌনতা সম্পর্কে কুসংস্কার। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চিকিৎসা মনোবিজ্ঞান থেকে পরিচালিত একটা গবেষণায় (Mozumder,K. and Rahman, M 2004) দেখা যায় যে বাংলাদেশের ৯২% মানুষের মধ্যে যৌনতা সম্পর্কে নানা রকম কুসংস্কার এ বিশ্বাস রয়েছে।
বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে মনে করা হয় শুধু পুরুষদের মধ্যেই যৌন সমস্যা দেখা যায়। কিন্তু ধারণাটি একদমই অমূলক। নারীদের মধ্যে ও যৌন সমস্যা দেখা দেয় প্রবলভাবে যার জন্য মনোবিজ্ঞানীদের শরণাপন্ন হওয়া জরুরী। এবং এ সমস্ত সমস্যার পিছনে শারীরিক কোন কারন থাকে না। তার মানে শারীরিক ভাবে সম্পূর্ণ ফিট হওয়া সত্বেও যৌন স্বর্গসুখ থেকে অনেক নারী বঞ্চিত হতে পারে। যৌন সমস্যার কারনগুলা নিয়ে হয়তবা আরেকদিন লিখবো। আজকে এখানে আমার মূল আলোচনা হবে নারীদের মনোঃযৌন সমস্যাগুলো এবং এ সম্পর্কে কিছু ভুল ধারনা।
সাধারণত নারীদের মধ্যে ৬ ধরনের মনোঃযৌন সমস্যা দেখা দেয়। নিচে সেগুলোর সংক্ষিপ্ত বর্ননা দেয়া হলঃ
1. Impaired Sexual Interest ( যৌন আকাংখার অভাব):
এখানে নারীদের মধ্যে যৌন উত্তেজনা আসে এবং যৌন সুখ লাভ করেন কিন্তু তাদের যৌন কাজের প্রতি আগ্রহ কমে যায়। নিজের মধ্যে যৌন আগ্রহ কমে যাওয়ার কারনে সঙীর সব ধরনের যৌন আবেদন বা আচরন তীব্রভাবে প্রত্যাখ্যান করে এবং নারী নিজ উদ্যোগী হয়ে কখনও সঙীর সাথে যৌনতায় লিপ্ত হয় না। কিছু কিছু মহিলা সঙীর সাথে যৌনতায় আগ্রহ না পেলেও Masturbate করে যৌন সুখানুভূতি লাভ করে।
স্বামী স্ত্রীর মধ্যে পারিবারিক কলহ, ঝগড়াঝাঁটি, বিষন্নতা, সঙীর প্রতি সন্দেহবাতিকতা ইত্যাদি কারনে এ সমস্যা দেখা দিতে পারে।
2. Impaired Sexual Arousal ( যৌন উত্তেজনার অভাব):
এ সমস্যায় নারীকে পর্যাপ্ত উদ্দীপ্ত বা Foreplay করা সত্বেও তার শরীর যৌনকাজের জন্য সাড়া দেয় না। সাধারণত Foreplay করলে নারীর যোনিপথ ভেজে যায় বা পিচ্ছিল হয়ে যায় কিন্তু এ সমস্যার জন্য যতই foreplay করা হোক, নারীর যৌনিপথ সিক্ত বা পিচ্ছিল হয় না। এতে করে intercourse এর সময় যোনিপথে নারী তীব্র ব্যাথা বা জ্বালা অনুভব করেন। যেটার জন্য পরবর্তীতে যৌন কাজের প্রতি আগ্রহ কমে যায়।
বিষন্নতা, low self-esteem, anxiety, stress এবং দাম্পত্য কলহের কারনে এ সমস্যা দেখা দিতে পারে।
3. Orgasmic Dysfunction (চরমপুলকগত সমস্যা) :
চরমপুলক হলো যৌনমিলনের একটা পর্যায়ে তীব্র আনন্দদায়ক অনুভূতি।
এ ক্ষেত্রে নারীর মধ্যে যৌন উত্তেজনাসহ যৌনকাজে আগ্রহী হওয়া সত্বেও তাদের orgasm বা চরমপুলক (যৌন সুখের চরম পর্যায়) হয় না। কিছু কিছু নারী কোন পরিস্থিতিতেই চরমপুলক অনুভব করে না আবার কিছু কিছু নারী Masturbate বা হস্তমৈথুন করে চরমপুলক লাভ করে।
উপরোক্ত কারনগুলোর সাথে পুরুষ সঙীর দ্রুত বীর্যপাতের (Premature ejaculation) কারনে নারী চরমপুলক লাভ থেকে বঞ্চিত হতে পারে। সেক্ষেত্রে স্বামী স্ত্রী উভয়েরই মনোবিজ্ঞানীর কাছে চিকিৎসার জন্য যাওয়া দরকার।
4. Vaginismus (যৌনি পেশীর সংকোচন)
এ সমস্যার কারনে intercourse বা যৌন সঙমের সময় নারীর যৌনীর চারপাশের পেশীগুলো সংকুচিত হয়ে যায়। এতে করে সঙী লিঙ্গ প্রবেশ করাতে পারে না বা জোর করে প্রবেশ করালেও যৌনসঙম খুবই ব্যাথ্যাযুক্ত হয়। এতে করে যৌনকাজের প্রতি দুজনেরই আগ্রহ কমে যায়। সঙ্গীর মনে নেতিবাচক ধারনার জন্ম হয় যে তার স্ত্রী তাকে পছন্দ করে না বা অন্য কোন সমস্যা আছে। কিন্তু এ সমস্যায় যৌনি পেশীগুলো সংকুচিত হওয়ার পিছনে নারীর কোন নিয়ন্ত্রণ একেবারেই থাকে না। সম্পূর্ণ অনৈচ্ছিকভাবে পেশীগুলো সংকুচিত হয়ে যায় intercourse এর সময়।
যেসব নারী শৈশবকালে বা বয়ঃস্বন্ধিকালে বিভিন্ন নেতিবাচক যৌন অভিজ্ঞতার কারনে যৌনতাকে নোংরা, লজ্জাকর,পাপ মনোভাব নিয়ে বড় হয়েছে তাদের মধ্যে এ সমস্যা দেখা দিতে পারে। যৌনতা নিয়ে কোন তীব্র রকমের অপরাধবোধ কাজ করলেও এ সমস্যা দেখা দিতে পারে যেটার জন্য চিকিৎসা মনোবিজ্ঞানীদের শরণাপন্ন হওয়া জরুরি।
5. Dyspareunia (ব্যাথাযুক্ত যৌন মিলন):
যৌনমিলনের কারনে সুখানভুতি না পেয়ে নারী
যৌনমিলনের সময় যৌনির ভেতর প্রচন্ড ব্যাথা বা জ্বালাপোড়া অনুভব করে। এতে করে পরবর্তীতে যৌনমিলন থেকে দূরে থাকে। সঙীরসাথে সম্পর্কের অবনতি হয়।
এখানেও ছোট বেলা থেকে যেসব নারী যৌনতা নিয়ে নেতিবাচক ধারনা নিয়ে বড় হয়েছে তাদের এ সমস্যা দেখা দিতে পারে। যৌনতা পাপ, লজ্জা, নোংরা ইত্যাদি মনে করার কারনে যৌনাঙ্গ নিয়ে উদ্বিগ্ন, ছেলেদের সাথে যৌনতা নিয়ে কথা না বলা, যৌনতা বিষয়ে আলেচনা থেকে নিজেকে সরিয়ে রাখার কারনে পরবর্তীতে এ সমস্যা দেখা দিতে পারে।
6. Sexual Aversion (যৌন অপছন্দ)ঃ
এ সমস্যার কারনে নারী তার সঙ্গীকে বিভিন্ন কারনে যেমন লিঙ্গের ধরন বা আকার, বীর্য ইত্যাদির কারনে অপছন্দ করে। অনেক নারীর বীর্য দেখলে ঘৃণা লাগে তাই তারা সঙ্গীর সাথে যৌনকার্য থেকে বিরত থাকে। জোরপূর্বক বিয়ে দেয়ার কারনে অনেক নারী তাদের সঙ্গীকে অপছন্দ করে যৌনকাজ থেকে দূরে থাকতে পারে।
উপরের সমস্যাগুলোর জন্য চিকিৎসা মনোবিজ্ঞানীরা Sex therapy দিয়ে থাকেন যাদের এ বিষয়ের উপর বিশেষায়িত প্রশিক্ষণ থাকে। কাজেই কারো মধ্যে যদি সমস্যাগুলো দেখা যায় বা যৌনজীবন অসুখের হয়, তাহলে কোন রকম ভুল চিকিৎসা না নিয়ে সরাসরি চিকিৎসা মনোবিজ্ঞানীদের শরণাপন্ন হওয়া উচিৎ।
নারীদের কিছু যৌন কুসংস্কার ঃ
1. ভুল ধারনা: নারীদের চরমপুলকের সময় পুরুষের মত বীর্য বের হয়।
সঠিক ধারনাঃ আমাদের দেশে অনেক নারীদের মধ্যে এ ভুল ধারনা থাকে। নারীরাও চরমপুলক লাভ করে তবে পুরুষের মত বীর্য বের হয়না। চরমপুলকের সময় নারীদের যৌনির Pubococcygeus মাংসপেশীর ৫-১৫ বার ছন্দময় সংকোচন হয়। এসময় স্বাভাবিকের চেয়ে বেশী যৌনিরস বের হতে পারে তবে তা বীর্য নয়।
2. ভুল ধারনা : পুরুষদের লিঙ্গের উপর নারীদের orgasm বা চরমপুলক নির্ভর করে। লিঙ্গ মোটা বা বড়, কমপক্ষে ৮ ইঞ্চি না হলে যৌনতৃপ্তি হয় না।
সঠিক ধারনাঃ যৌনতৃপ্তির সাথে ছোট বড় লিঙ্গের সম্পর্ক নাই। মেয়েদের যোনিপথ ১০ সেমি বা ৪ ইঞ্চি পর্যন্ত লম্বা। যৌনিপথের প্রথম এক তৃতীয়াংশ সবচেয়ে বেশী উত্তেজনাকর স্থান। বাকি অংশে কম উত্তেজনা থাকে। যৌনতৃপ্তি নির্ভর করে প্রথম অংশে কতটা ঘর্ষন হচ্ছে তার উপর। যৌনির ভিতরের অংশটি স্থিতিস্থাপক হওয়ায় যেকোন আকারের লিঙ্গ প্রবপশ করানে হোকনা কেন সেটা যৌনি খাপ খাইয়ে নেয়।
৩. ভুল ধারনা : যৌন মিলনের সময় স্বামী স্ত্রী একসাথে চরমপুলক লাভ না করলে গর্ভধারন সম্ভব নয়।
সঠিক ধারনাঃ গর্ভধারনের জন্য চরমপুলক মুখ্য বিষয় না। যৌন মিলনের সময় যৌনির যেকোন জায়গায় বীর্যপাতের ফলে পরিপক্ব শুক্রাণু যৌনির Fallopian tube এ প্রবেশ করে নিষিক্ত হয়ে গর্ভধারন ঘটায়। অনেক স্বামী স্ত্রী র মধ্যে যৌন জীবন সুখের না হলেও গর্ভধারন ঘটে যায়।
৪. ভুল ধারনা : পুরুষের বীর্য পাতলা হলে বাচ্চা হওয়ার সম্ভাবনা নেই।
সঠিক ধারনাঃ এটা ডাহা অবৈজ্ঞানিক একটা ধারনা। শুক্রাণু এবং ডিম্বাণুর পরিপক্বতা ও সুস্থতার উপর নির্ভট করে।
৫. ভুল ধারনা : মেয়েরা হস্তমৈথুন করলে যৌনশক্তি কমে যায়। মূলত হস্তমৈথুন পুরুষদের কাজ।
সঠিক ধারনাঃ যৌনসঙ্গী এবং যৌনকাজ না করেই যৌন সুখ পাওয়ার স্বাভাবিক এবং প্রাকৃতিক একটা উপায় হলো হস্তমৈথুন বা Masturbation. হস্তমৈথুনের সাথে যৌনশক্তি কমার কোন সম্পর্ক নাই। তবে সেটা স্বাভাবিক মাত্রায় হওয়া ভাল। অতিরিক্ত সবকিছুরই খারাপ দিক আছে।
আর পুরুষদের পাশাপাশি নারীরাও হস্তমৈথুন করে। আমেরিকাতে একটা গবেষণায় দেখা গেছে ৯২% পুরুষ আর ৬২% নারীর মধ্যে হস্তমৈথুন এর অভিজ্ঞতা আছে।