আচ্ছা এই মুহূর্তে আপনি কি দুঃখী? নাকি আপনার মন খারাপ? নাকি বিষন্ন? নাকি দুঃখকে মনের ভিতর পুষে রাখতে রাখতে মন পাথরে পরিণত হয়েছে?  নাকি আপনি অল্প একটু দুঃখ পেলে কান্না করে ফেলেন? নাকি দুঃখ থেকে সবসময় পালিয়ে বাঁচতে চান? নাকি আপনি কেবলই দুঃখবিলাসী!

প্রতিটা মানুষের জীবনের অন্যতম প্রধান লক্ষণ হলো জীবনে সুখী হওয়া। জীবনে সুখের জন্য আমাদের নানা চড়াই-উৎরাই পাড়ি দিতে হয়। মুদ্রার এ পিঠকে  সুখকর করার জন্য উল্টা পিঠের দুঃখটা অনুভব করতে হয়। তবে জীবনে আমরা কেউই দুঃখ অনুভব করতে চাইনা। আমরা সবাই চেষ্টা করি দুঃখটাকে প্রশমিত করতে। সবসময় সুখে থাকতে। সুখ যেমন আমাদের জীবনে একান্ত কাম্য, ঠিক তেমনি দুঃখটাও চিরন্তন সত্য, জীবনের অবিচ্ছেদ্য এক অংশ। জীবনে দুঃখ থাকা ভালো, কারণ আমরা জানি দুঃখ না থাকলে সুখটা অনুভব করা যেত না। তবে কেউ যদি দুঃখ নিয়ে ভীত হয়ে থাকেন এবং তাহার মাঝে যদি দুঃখ ভীতি দেখা দেয় তাহলে সেটি চিন্তার বিষয়। চিকিৎসা বিজ্ঞান এবং মনবিজ্ঞানে দুঃখের প্রতি ভয় কাজ করা বা দুঃখ ভীতিকে বলা Algophobia হয়। Algophobia শব্দটি গ্রিক। Algo শব্দের অর্থ দুঃখ এবং Phobia অর্থ ভয়।

 

চলুন এবার তাহলে জানার চেষ্টা করি আপনি দুঃখ বিলাসি নাকি দুঃখে ভীতু? জীবনের যেকোনো সময়, যেকোনো মুহূর্তে দুঃখ আমাদের স্পর্শ করতে পারে। তবে কিছু কিছু ঘটনার কারণে দুঃখগুলো আমাদের ভয়ের কারণ হয়ে দাঁড়ায়। যদিও অনেকে মনে করেন Algophobia হওয়ার জন্য নির্দিষ্ট তেমন কোনো কারণ নেই তবে বিভিন্ন গবেষণায় কিছু কারণ বা  প্রভাব কে উল্লেখ করা হয়েছে। চলুন এবার জেনে নেওয়া যাক কিসের প্রভাবে Algophobia হতে পারে।

 

ALGOPHOBIA এর প্রভাবক সমূহঃ

★মানসিক আঘাতঃ

নানান ভাবে আমাদের জীবনে আমরা মানসিকভাবে অনেক আঘাত পেয়ে থাকি। যেমন ধরুন আমাদের কোনো নিকটাত্মীয়ের মৃত্যু বা অনাকাঙ্ক্ষিত কোন দুর্ঘটনা কিংবা আমাদের পছন্দের কোনো কিছু হারিয়ে যাওয়া বা না পাওয়া ইত্যাদি কারণে অনেকেই মারাত্মকভাবে মানসিক কষ্ট পেয়ে থাকেন। যার ফলশ্রুতিতে সেসকল মানুষদের দুঃখ সহ্য করার শক্তি বা ক্ষমতা হ্রাস পায়। ক্রমান্বয়ে তাদের মাঝে Algophobia দেখা দিতে পারে।

 

★ পারিপার্শ্বিক পরিবেশঃ

আমাদের জীবনের সুখ-দুঃখের অনেকাংশই নির্ভর করে আমাদের আশেপাশের পরিবেশের উপর। যেখানে একটি বড় ভূমিকা পালন করে আমাদের পরিবার, বন্ধু কিংবা আমরা কোন পরিবেশে বসবাস করছি তার উপর।  অনেক সময় দেখা যায় নিজের কাছের মানুষের থেকে প্রতিনিয়ত বিভিন্ন কটাক্ষ ও অনাকাঙ্ক্ষিত মন্তব্য একজন মানুষের মনে চাপা দুঃখ সৃষ্টি করতে পারে। যার ফলে ক্রমশই একজন মানুষের মাঝে দুঃখ সহিষ্ণুতা কমে আসে। আস্তে আস্তে তার মাঝে Algophobia এর  লক্ষণগুলো দেখা দিতে পারে।

 

★বয়সঃ

বয়সে যারা প্রবীণ তাদের মাঝে Algophobia এর বেশি ঝুঁকে দেখা যায়। কারণ বয়স বৃদ্ধির সাথে সাথে তাদের দুঃখ সহ্য করার ক্ষমতা কমে আসে। অনেক সময় পুরনো স্মৃতি মনে করে তারা হতাশাগ্রস্থ এবং দুঃখ ভারাক্রান্ত হয়ে পড়েন। অনেক সময় তারা নিজেদের কাছের মানুষকে হারানোর ফলেও Algophobia তে ভুগতে পারেন। আক্রান্ত প্রবীনদের সংখ্যা বেশি হলেও, নতুন প্রজন্ম  যুবসমাজের সংখ্যাও নেহায়েত কম নয়।

 

★ অন্য ফোবিয়ার প্রভাবঃ

Algophobia এর ক্ষেত্রে অন্য যেকোন ফোবিয়ার প্রভাবও লক্ষ্য করা যায়। অনেক ক্ষেত্রে দেখা যায়, কোনো ব্যক্তি যদি কোনো নির্দিষ্ট ফোবিয়াতে ভুগেন সেক্ষেত্রে তার মাঝে Algophobia ও বিভিন্ন মাত্রায় প্রকাশ পেতে পারে।

 

★ রোগ ও শারীরিক অক্ষমতাঃ

আমাদের মাঝে যারা বিভিন্ন শারীরিক রোগ এবং সমস্যায় দীর্ঘদিন ভুগছেন তাদের মাঝেও Algophobia দেখা দিতে পারে। দীর্ঘদিন ধরে একটি রোগে ভুগার কারণে এবং অসহনীয় কষ্ট গুলো সহ্য করার কারণে তারা মানসিকভাবে ভেঙে পড়েন। একইসাথে দুঃখ সহ্য করার ক্ষমতাও হারিয়ে ফেলেন। যার ফলে তাদের মাঝে বিভিন্ন মাত্রার Algophobia পরিলক্ষিত হয়।

 

ইতিমধ্যে কোন বিষয়গুলো প্রভাবে একজন মানুষ Algophobia তে ভুগতে পারেন সে বিষয়গুলো সম্পর্কে আমরা একটি সামগ্রিক ধারণা পেয়েছি। চলুন তাহলে এবার জেনে নেই Algophobia তে আক্রান্ত হলে কি কি লক্ষণ দেখা দিতে পারে।

ALGOPHOBIA এর লক্ষণঃ

  • অতিরিক্ত দুশ্চিন্তা করা,
  • দুঃখের ঘটনা চিন্তা করা থেকে নিজেকে বিরত রাখতে না পারা,
  • দুঃখ পেতে পারেন এমন অবস্থা থেকে নিজেকে আড়াল করে রাখা,
  • হৃদস্পন্দন বেড়ে যাওয়া,
  • অতিরিক্ত ঘামা,
  •  হাত পায়ে কম্পন সৃষ্টি হওয়া,
  •  চিৎকার করে কিংবা একান্তে কান্না করা,
  •  অতিরিক্ত মাথা ব্যথা করা,
  • রক্তচাপ বেড়ে যাওয়া,
  • স্বাভাবিক ঘুম ব্যাহত হওয়া,
  • ক্রোধের নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেলা,
  • ছটফট করা বা অস্থির হয়ে যাওয়া,ইত্যাদি।

এসকল লক্ষণ দেখা দিলেই যে একজন মানুষের Algophobia হয়েছে বা ভুগছেন বিষয়টি তা নয়। এমনও হতে পারে তিনি অন্য কোনো ফোবিয়াতে ভুগছেন। তাই Algophobia তে ভুগছেন কিনা সেটি নিশ্চিত হওয়ার জন্য অবশ্যই কোন মনোবিজ্ঞানী বা মানসিক স্বাস্থ্যের চিকিৎসকের পরামর্শ গ্রহণ করতে হবে।

 

প্রত্যেকটি সমস্যারই কিছু না কিছু সমাধান থাকে। তেমনি Algophobia ও কিছু  চিকিৎসা রয়েছে। এবার তাহলে সেই সকল চিকিৎসা বা ট্রিটমেন্ট সম্পর্কে জেনে নেওয়া যাক।

 

ALGOPHOBIA এর ট্রিটমেন্টঃ

★এক্সপোজার থেরাপি ( EXPOSURE THERAPY):

যেকোনো ফোবিয়া এর ক্ষেত্রে এক্সপোজার থেরাপিটি বেশ কার্যকর। প্রায় সকল ধরনের ফোবিয়ার ক্ষেত্রেই চিকিৎসকগণ এই থেরাপিটি ব্যবহার করেন। মূলত এই থেরাপিটি কে আপনি গোয়েন্দাগিরি বা অনুসন্ধানের সাথে তুলনা করতে পারেন। অর্থাৎ চিকিৎসক ভুক্তভোগীর সাথে কথা বলে, ভুক্তভোগীর মাধ্যমে তাকেই তার ফোবিয়া সংক্রান্ত বিভিন্ন ভয় এবং সমস্যাগুলি খুঁজে বের করতে সাহায্য করেন। যার ফলে একজন ব্যক্তি নিজের ফোবিয়া সম্পর্কে জানতে পারেন এবং নিজের দুর্বল দিক গুলোর ব্যাপারে সচেতন হতে পারেন। ধীরে ধীরে তার ভয় দূর হয়ে যায়।

 

★ কগনিটিভ বিহেভিয়ার থেরাপি  ( COGNITIVE BEHAVIORAL THERAPY ):

বিভিন্ন মানসিক সমস্যা এবং ফোবিয়ার ক্ষেত্রে ব্যাপকভাবে প্রয়োগকৃত এবং প্রচলিত একটি থেরাপি এটি। এর মাধ্যমে সাধারনত ব্যক্তির বিভিন্ন সময় তার ব্যবহার,আচরণ এবং অনুভূতি প্রকাশের ধরনগুলো বিশ্লেষণ করা হয়। এসকল বিষয় বিশ্লেষণের পর চিকিৎসক ভুক্তভোগী কে তার ব্যবহার উপর নিয়ন্ত্রণ আনতে বিভিন্ন পদ্ধতিতে সাহায্য করেন।

 

★ডায়ালেকটিক বিহেভিয়ার থেরাপি  (DIALECTICAL BEHAVIOR THERAPY (DBT)):

DBT আরও একটি কার্যকরী থেরাপি। এর মাধ্যমে সাধারণত চিকিৎসকগণ, দুঃখকে কিভাবে সুন্দরভাবে নিয়ন্ত্রণ করা যায় সেই বিষয়গুলি একজন আক্রান্ত ব্যক্তিকে শিখান। ট্রিটমেন্ট দেওয়ার ক্ষেত্রে চিকিৎসকগণ কিছু মডিউল অবলম্বন করেন। তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য কিছু মডিউল হলো,

হাফ স্মাইলিং মডিউল  (Half-Smiling Module):

এখানে চিকিৎসক আক্রান্ত ব্যক্তি কে মুখে মুচকি হাসির মাধ্যমে তার দুঃখ গুলো প্রকাশ করার পদ্ধতিগুলো শেখান। আপনারা অনেকেই হয়তো খেয়াল করেছেন, আমরা যখন হেসে কোনো কথা বলি বা কোন কিছু প্রকাশ করি, সে ক্ষেত্রে আমরা কিছুটা কম হলেও দুঃখ অনুভব করি।

মাইন্ডফুলনেস মডিউল (Mindfulness Module):

এ মডিউলের মাধ্যমে চিকিৎসকগণ আক্রান্ত ব্যক্তিকে, কিভাবে বর্তমান সময়ে মনোযোগ দেওয়া যায় এবং কি উপায় আশেপাশে যে সকল বিষয়ে ঘটছে সেগুলোর প্রতি বেশি মনোনিবেশ করা যায় এবং কিভাবে অতীতের দুঃখ গুলো ভুলে থাকা যায় সেই বিষয়গুলি শিখান।

ডিস্ট্রেস টলারেন্স স্কিল (Distress Tolerance Skills):

এখানে চিকিৎসক আক্রান্ত ব্যক্তি কে কিছু মানসিক দক্ষতায় দক্ষ করে তুলেন। ফলশ্রুতিতে আক্রান্ত ব্যক্তি ধীরে ধীরে তার আবেগ ও অনুভূতি উপর নিয়ন্ত্রণ রাখতে পারেন এবং যেকোন খারাপ সময়ে তিনি শান্ত থেকে সমস্যার সমাধান করার কৌশল রপ্ত করতে পারেন।

 

উল্লেখিত ট্রিটমেন্টগুলো Algophobia দূর করতে বেশ কার্যকরী ভূমিকা পালন করে। তবে কেউ চাইলে ব্যক্তিগত পর্যায়েও কিছু কার্যক্রমের মাধ্যমে এই ফোবিয়া নিয়ন্ত্রণে রাখতে পারেন। যেমন ধরুন,

  • অতিরিক্ত চিন্তা না করা,
  • সুচিন্তায় নিজেকে ব্যস্ত রাখা,
  • নিজের আবেগের উপর নিয়ন্ত্রণ রাখার চেষ্টা করা,
  • নিজের ভালো লাগে এবং মন ভাল থাকে এমন কাজ গুলো বেশি বেশি করা,
  • পরিবার, প্রিয় মানুষ এবং বন্ধুদের সাথে দুঃখগুলো ভাগ করে নেওয়া,
  • অপরের দুঃখে সাহায্য করা,
  • ব্রিদিং এক্সারসাইজ করা,
  • ইয়োগা করা,
  • মেডিটেশন বা ধ্যান করা,  ইত্যাদি।

 

দুঃখ আমাদের জীবনের অবিচ্ছেদ্য অংশ। আমরা কেউ চাইলেও দুঃখকে আমাদের জীবন থেকে সরিয়ে ফেলতে পারব না। তবে আমরা যেটি করতে পারি, তা হল দুঃখ পেলে অতিরিক্ত দুশ্চিন্তা না করে, হতাশায় না পড়ে,  কোন জিনিসের কারণে আমরা দুঃখ পাচ্ছি সেই জিনিসটা খুঁজে বের করা এবং কোন জিনিসটি করলে দুঃখ থেকে মুক্তি পাবো সেই বিষয়টি খুঁজে বের করা। প্রয়োজনে এ বিষয় নিয়ে পরিবার, বন্ধু কিংবা চিকিৎসকের পরামর্শ নিয়ে সমস্যাকে সমাধান করে ফেলা। সবসময় মনে রাখতে হবে আমাদের জীবনের অধিকাংশ দুঃখই চিরস্থায়ী নয়। চাইলে দুঃখ কে ও উপভোগ করা যায়। যদি দুঃখ নাই থাকে, তাহলে তো আমরা সুখ উপভোগ করতে পারবোনা। আমরা যেমন নিজেরা দুঃখ পেলে, সেটা থেকে যত দ্রুত সম্ভব বেরিয়ে আসার চেষ্টা করি। ঠিক তেমনি অন্য কেউ দুঃখে থাকলে, তার দুঃখ সমাধানের চেষ্টা করতে হবে।  এতে করে সেই মানুষটিও যেমন দুঃখ থেকে পরিত্রান পাবে, ঠিক তেমনি আমরাও এক অসাধারণ মানসিক শান্তি পাবো।

Algophobia কিংবা কোনো ফোবিয়াই (Phobia) দুশ্চিন্তা কারণ নয়। সঠিক চিকিৎসা এবং নিয়ন্ত্রিত জীবনযাপন এর মাধ্যমে এগুলো থেকে খুব সহজেই মুক্তি পাওয়া যায়। আপনি বা আপনার পরিচিত কেউ যদি কোন মানসিক স্বাস্থ্যজনিত সমস্যার সম্মুখীন হন, তাহলে নির্দ্বিধায় চিকিৎসকের শরনাপন্ন হতে পারেন।

 

প্রান খুলে হাসুন, সুন্দর একটি জীবন বাঁচুন। নিজে ভালো থাকুন,ভালো রাখুন নিজের কাছের মানুষকে। আপনার পরিবেশটা সুন্দর রাখুন,তাহলে ভাল থাকবেন আপনি ভালো থাকবে আপনার পরিবার। আর আমরা ভাল থাকলে ভালো থাকবে পৃথিবী।

Ali Mortuza

Scroll to Top