তন্নির সামনে ভর্তি পরীক্ষা। খুব ভালোমতোই সে পরীক্ষার জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছে৷ কিন্তু ইদানীং দেখা যাচ্ছে সে কোনো কারণ ছাড়াই অস্থির হয়ে উঠছে৷ অযথা অতিরিক্ত কথা বলে যাচ্ছে, কারো কথা মনোযোগ দিয়ে শুনছে না, অন্যমনস্ক থাকছে। আবার হুট করেই তার মন অনেক ভালো হয়ে যাচ্ছে, সবার সাথে হেসে হেসে কথা বলছে, শপিংয়েও যাচ্ছে। যখন সে ভালো মুডে থাকে, তখন তার পরিবারের সবাই নিশ্চিন্তে থাকে৷ কিন্তু হুটহাট করেই যখন তার মুড খারাপ হয়ে যায়, তখন সে ভাঙচুর শুরু করে আর বাসার সবাই তটস্থ হয়ে থাকে। তন্নির এমন অবস্থা দেখে তার বাবা-মা মনোরোগ চিকিৎসকের কাছে নিয়ে গেলেন। চিকিৎসক বললেন তন্নির রোগের নাম বাইপোলার মুড ডিসঅর্ডার (বিএমডি)।

 

আচ্ছা, আপনারও কি কখনো তন্নির মতন মনে হয়েছে এই আপনার মন হয় তো ভালো আছে, পরক্ষণেই তা খারাপ হয়ে গেল?

 

বাইপোলার মুড ডিসঅর্ডার কী:

বাইপোলার মুড ডিসঅর্ডার হল একটি আবেগজনিত মানসিক সমস্যা। ‘বাই’ শব্দের অর্থ ‘দুই’ আর ‘পোলার’ হলো মাথা বা দিক। আমরা জানি, যার দুইটি পোল বা মেরু আছে, তাই বাইপোলার। এই দুই মেরু দুইটি ভিন্ন আবেগ প্রদর্শন করে। এক মেরুতে থাকে বিষণ্নতা বা ডিপ্রেশন, যেখানে আবেগের প্রকাশ কম, কোনো কিছুই ভালো লাগে না, দুঃখবোধ হয়, সবকিছু বিরক্তিকর ঠেকে। আরেক মেরুতে অতি উৎফুল্লতা বা ম্যানিয়া, যেখানে আবেগের উচ্ছলতা বেশি। কখনো ম্যানিয়া আবার কখনো বিষণ্নতা দেখা যায়। আর মাঝখানের সময়টায় বিরতির মতন, সাধারণত সম্পূর্ণ ভালো থাকে। সবসময় কেবল বিষণ্নতার প্রকাশ খুব একটা হয় না, শুধু ম্যানিয়া নিয়েও এ সমস্যা প্রকাশ পেতে পারে।

 

বাইপোলার মুড ডিসঅর্ডারের দুটি দিক থাকে। একদিকে থাকে ‘ডিপ্রেশন বা বিষণ্ণতা’, অপরদিকে থাকে ‘ম্যানিক কন্ডিশন’। শুনতে মোটামুটি শুনতে মোটামুটি স্বাভাবিক মনে হলেও বিষয়টি খুবই গুরুতর ও স্পর্শকাতর।

 

বাইপোলার মুড ডিসঅর্ডারের লক্ষণ

  • অশান্তি বোধ, হতাশা, মন খারাপ, কোনো কারণ ছাড়া কান্নাকাটি করা।
  • অতি উৎফুল্ল, মনে সব সময় ফুর্তি আর আনন্দ অনুভব, খিটখিটে মেজাজ অথবা রাগান্বিত ভাব।
  • আনন্দদায়ক বিষয় ও ঘটনায় আনন্দ না পাওয়া।
  • আত্মবিশ্বাস কমে আওয়া, নিজেকে হীন, তুচ্ছ ও অকর্মণ্য মনে করা
  • দোষ না করেও নিজেকে দোষী ভাবা।
  • ছোট ছোট জিনিস ভুলে যাওয়ার প্রবণতা।
  • আত্মহত্যার চিন্তা, প্রবণতা ও মরে যাওয়ার ইচ্ছা।
  • ক্ষিদে কমে যাওয়া বা কখনো অতিরিক্ত খাদ্য গ্রহণ।
  • অতিরিক্ত, দ্রুত ও উচ্চস্বরে বেশি বেশি কথা বলা।
  • নিজেকে বড়, ক্ষমতাশালী, বিশেষ শক্তির অধিকারী মনে করা।
  • এক চিন্তা থেকে আরেক চিন্তায় দ্রুত চলে যাওয়া।
  • ওজন কমে যাওয়া বা ওজন বেড়ে যাওয়া।
  • অতিরিক্ত কর্মতৎপর হয়ে যাওয়া, শরীরে ও মনে অতিরিক্ত শক্তি অনুভব করা।
  • মনোযোগ কমে যাওয়া।
  • বেশি বেশি খরচ করার প্রবণতা তৈরি হয়।
  • ঘুমের প্রয়োজনীয়তা কমে যাওয়া অর্থাৎ ঘুম এলেও ঘুমাতে না চাওয়া
  • নিজেকে মোটেই কোনো রোগী বলে স্বীকার না করা।
  • হঠাৎ করে উত্তেজিত হয়ে অন্যকে আঘাত করা, ভাঙচুর করা।
  • অপ্রাসঙ্গিকভাবে গান গাওয়া, নাচা।
  • শরীরের বিভিন্ন স্থানে ব্যথা ও মাথাসহ শরীরে জ্বালা-পোড়া।
  • যৌনস্পৃহা কমে যাওয়া।
  • কোষ্ঠকাঠিন্য।
  • অতিরিক্ত ক্লান্তিবোধ।
  • নারীদের ক্ষেত্রে মাসিকের সমস্যা।

 

কমপক্ষে দুই সপ্তাহ ধরে এই লক্ষণগুলো থাকলে তবে রোগীর বিষণ্নতা আছে বলে ধরে নেওয়া হয়।

 

বাইপোলার মুড ডিসঅর্ডার কেন হয়:

এই রোগের কারণ এখনো নির্দিষ্ট করে এবং পরিষ্কারভাবে জানা যায়নি। তবে কিছু জেনিটিক্যাল (জিনগত) ও বায়োলজিক্যাল (জৈবিক) পরিবর্তনের কারণে এই রোগ হওয়ার প্রমাণ পাওয়া যায়। এ ছাড়া অস্বাভাবিক মস্তিষ্কের গঠনের কারণে এ রোগ হতে পারে।

 

নিউরোট্রান্সমিটারের পরিবর্তনের কারণেও অনেক ক্ষেত্রে এটি হতে পারে। আবার জেনেটিক এবং বায়োলজিক্যাল কারণের পাশাপাশি পরিবেশের বিভিন্ন কারণেও এই রোগ হয়। মস্তিষ্কে নরঅ্যাড্রেনালিন, সেরোটনিন, ডোপামিন জাতীয় বিভিন্ন নিউরোট্রান্সমিটারের (একধরনের রাসায়নিক উপাদান) ভারসাম্যহীনতা, তীব্র মনঃসামাজিক চাপ, স্নায়ুবিকাশজনিত সমস্যা, নেশাজাতীয় দ্রব্যাদি গ্রহণ ইত্যাদি কারণে এ সমস্যা হতে পারে বলে ধারণা করা হয়।

 

বাইপোলার মুড ডিসঅর্ডারের চিকিৎসা:

সঠিক সময়ে রোগটি শনাক্ত করার পর মনোরোগ বিশেষজ্ঞের পরামর্শে ধৈর্য ধরে ওষুধ সেবন করলে বাইপোলার ডিসঅর্ডারের ব্যক্তি সুস্থ স্বাভাবিক জীবন যাপন করতে পারেন।

 

বাইপোলার মুড ডিজঅর্ডারে ম্যানিক এবং বিষণ্ণতা দুটো বিষয়ের একসঙ্গে চিকিৎসা করা হয়। কয়েক ধরনের ওষুধ দিয়ে চিকিৎসা করা হয়। এই ক্ষেত্রে মুড স্ট্যাবিলাইজার জাতীয় ওষুধ দিতে হয়। মেজাজ স্বাভাবিক রাখার জন্য এ ধরনের ওষুধ ব্যবহার করা হয়। বিষণ্ণতা অথবা ম্যানিক পর্যায়, কোনোদিকই যেন রোগীকে পেয়ে না বসে; সেজন্য মনকে মাঝখানে ধরে রাখতে এই ধরনের ওষুধ দেওয়া হয়। এ ছাড়া বিষণ্ণতায় আক্রান্ত মনকে স্বাভাবিক অবস্থায় আনার জন্য অ্যান্টিডিপ্রেশন জাতীয় ওষুধ ব্যবহার করা হয়। পাশাপাশি ম্যানিক পর্যায়ের চিকিৎসার জন্য অ্যান্টিসাইকোটিক ওষুধ রোগীকে সেবন করতে দেওয়া হয়।

 

অ্যান্টিসাইকোটিক ওষুধগুলো ম্যানিয়া থেকে নামিয়ে বিষণ্ণতার পর্যায়ে নিয়ে আসে। তখন মুড স্ট্যাবিলাইজার ব্যবহার করা হয়। মুড স্ট্যাবিলাইজার জাতীয় ওষুধ তিন থেকে পাঁচ বছর খেতে হয়। এই চিকিৎসার উদ্দেশ্য হলো বিষণ্ণতার কারণে অতি খারাপ মনকে ভালোর দিকে আনা এবং ‘অতি ভালো’ থাকা মন বা ম্যানিক পর্যায়ের মনকে স্বাভাবিক অবস্থায় আনা।

 

রোগটি যাতে আর ফিরে না আসে তার জন্য ক্লিনিক্যাল সাইকোলজিস্টের কাছে পরামর্শ বা সাইকোথেরাপি নিতে হবে। ক্লিনিক্যাল সাইকোলজিস্টরা রোগীকে নিজের অবস্থা পর্যবেক্ষণ করতে শেখান এবং রোগটি যাতে বেড়ে না যায় এ জন্য করণীয় পদ্ধতি শেখান।

 

ম্যানিয়া তিন থেকে ছয় মাস পর্যন্ত স্থায়ী থাকে। বিষণ্ণতা এক মাস থেকে ছয় মাস থাকে। বিষণ্ণতার ক্ষেত্রে সাইকোথেরাপি নিলে অনেকে সুস্থ হয়। তবে প্রয়োজন হলে রোগীকে হাসপাতালে ভর্তি হতে হবে। ওষুধ খাওয়ার এক মাসের মধ্যে ভালো অবস্থায় চলে আসে।

 

তবে সময়মতো সঠিক চিকিৎসা না পেলে সম্পদ বিনষ্টসহ আত্মহত্যা বা অপরকে হত্যার মতো দুর্ঘটনা ঘটিয়ে ফেলতে পারেন। তাদের মধ্যে মাদকে আসক্ত হওয়াসহ ঝুঁকিপূর্ণ কাজে জড়িয়ে পড়ার আশঙ্কা বেশি।

 

বাইপোলার মুড ডিসঅর্ডার রোধে করণীয়:

বাইপোলারের লক্ষণ দেখা দিয়েছে এমন ব্যক্তির সঙ্গে অযথা তর্কে জড়াবেন না। তাকে অপরাধী মনে করবেন না, উত্ত্যক্ত করবেন না। তার কোনো আচরণের জন্য দায়ী করে মারধর করবেন না।

 

যত দ্রুত সম্ভব মনোরোগ বিশেষজ্ঞের শরণাপন্ন হন। মনে রাখবেন, বাইপোলার মুড ডিসঅর্ডার একটি সাইকোসিস ঘরানার রোগ, যার মূল চিকিৎসা হচ্ছে নিয়মিত ওষুধ সেবন। এই সমস্যায় আক্রান্ত ব্যক্তির কেনাকাটা, ব্যাংকের কাগজ, ক্রেডিট কার্ড, জমি ও বাড়ির দলিল অভিভাবকের নিয়ন্ত্রণে রাখতে হবে।

 

নিজেকে সব সময় পর্যবেক্ষণ করতে হবে। ম্যানিক পর্যায়ে চলে গেলে নিজেকে শান্ত রাখার চেষ্টা করতে হবে। সব ধরনের অতিসক্রিয়তা থেকে নিজেকে মুক্ত রেখে নিজেকে শান্ত করার চেষ্টা করতে হবে।

 

এ রকম সমস্যা রোগীর প্রতি পরিবারের যত্ন অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ জানিয়ে তিনি বলেন, পারিবারিক সচেতনতা অত্যন্ত প্রয়োজনীয় একটি বিষয়। লোকলজ্জার ভয়ে না থেকে ব্যক্তিকে মানসিক চিকিৎসকের কাছে নিয়ে যেতে হবে। এতে করে ব্যক্তি ও পরিবারের সদস্যরা রোগটি সম্বন্ধে প্রয়োজনীয় তথ্য বা নির্দেশনা পাবে এবং কখন কী করতে হবে সেসব বিষয়ে সচেতন হতে পারবে।

 

বাইপোলার মুড ডিসঅর্ডার কাদের হয়?

আমেরিকান অ্যাকাডেমি অব চাইল্ড অ্যান্ড অ্যাডোলেসেন্ট সাইকিয়াট্রির এক রিপোর্টে বলা হয়, বাইপোলার মুড ডিজঅর্ডারে আক্রান্ত শতকরা ৬০ ভাগ বয়স্ক ব্যক্তির ক্ষেত্রে প্রথম লক্ষণ দেখা দেয় কৈশোরে বা তার আগে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার তথ্য মতে, বাইপোলার ডিজঅর্ডার সারা বিশ্বে ষষ্ঠ অক্ষমতার কারণ। বাংলাদেশে জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউট ও বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার এক যৌথ জরিপের প্রাপ্ত ফলাফলে দেখা যায়, গবেষণায় অংশ নেওয়া প্রতি ১০০০ জন মানুষের মধ্যে ৪ জন বাইপোলার মুড ডিসঅর্ডারে আক্রান্ত। বিভিন্ন বৈজ্ঞানিক গবেষণায় দেখা যায়, এক হাজার জন মানুষের মধ্যে ৩ থেকে ১৫ জনের রোগটি রয়েছে। নারী-পুরুষ উভয়েরই এ রোগে আক্রান্ত হওয়ার আশঙ্কা সমান। সাধারণত তরুণ বয়সে এই রোগের লক্ষণ শুরু হয়, তবে যেকোনো বয়সেই এমনকি শিশুদের ও বৃদ্ধ বয়সেও এ রোগের লক্ষণ দেখা দিতে পারে।

Musharrat Abir

Scroll to Top