ঘুম শুনলেই আরামদায়ক একটা অনুভুতি আসে মনে। কারো কারো কাছে ঘুম বিষয়টা খাওয়া দাওয়া বা অন্যান্য প্রিয় কাজের থেকেও প্রিয়। কিন্তু ঘুম কি? কেনো ঘুমাই আমরা? – প্রশ্নটা শুনলে অতো জটিল কিছু আসে না মাথায়। তাই না? একটা নির্দিষ্ট সময়ে চোখ বন্ধ করলাম আর ঘুমিয়ে পরলাম? অথবা এটা একটা প্রাকৃতিক নিয়ম, তাই সবার মত আমরাও ঘুমাই? অথচ বিষয় টা এতটাও সরল না। বহু বছর যাবৎ গবেষকগণ এই বিষয় নিয়ে ভাবছেন, গবেষণা করে যাচ্ছেন –

আমরা কেন ঘুমাই? – এই প্রশ্নের উত্তর খুজে বেরাচ্ছেন। নানান জনে নানান মতবাদ দিয়েছেন, বেশ কয়কটা তত্ত্ব ও
রয়েছে এর উপর। যেকোন একটি তত্ত্বই যে পরম সত্য, তা যেমন বলা যায় না আবার এগুলোর মধ্যে কোন টাকে বাদ ও দেওয়া যায় না। সব গুলো তত্ত্বই কিছু না কিছু গুরুত্বপূর্ণ ব্যাখ্যা দেয়।

আবার অনেকের কাছে ঘুম বিষয় টি যথেষ্ট কষ্ট উদ্রেককারীও হতে পারে। যেমন মনে করেন যেই মানুষটির ঠিক মত ঘুম হয় না এবং তার ফলে সে নানান সমস্যায় ভুগছেন – সে ঘুম নিয়ে অনেক দুশ্চিন্তায়ও থাকেন হয়তো। ঘুম নিয়ে অতিরিক্ত দুশ্চিন্তা করাও যেমন ক্ষতিকর হতে পারে, তেমনি ঘুম নিয়ে একদম হেলাফেলা করাও খুব উপকারি নয়।

ঘুম নিয়ে যেমন অনেক বৈজ্ঞানিক গবেষণা হয়েছে তেমনি কিছু অবৈজ্ঞানিক ভুল ধারণাও রয়েছে (যেগুলো বৈজ্ঞানিক ভাবে সত্য প্রমাণিত হয় নি) কিছু প্রচলিত ভুল ধারণা হলো –

– অল্প ঘুমালেও চলে/ পরিমিত না ঘুমালেও চলে
– বিভিন্ন উপায় ব্যাবহার করে জোর করে ঘুম আটকানো যায়
– বাকি থাকা ঘুম পরে ঘুমিয়ে নেওয়া যায়
– কারো দিন এর বেলা ঘুম পেলে, তার রাত এ ঠিক মত ঘুম হয় নি
– ঘুমের আগে টিভি দেখা, মোবাইল ফোন ব্যাবহার অথবা অ্যালকোহল সেবন তাড়াতাড়ি ঘুম আসতে সাহায্য করে
– ঘুম না আসতে থাকলে বিছানাতেই শুয়ে থাকতে হয়; শুয়ে থেকে উল্টা গুণা অথবা তারা গুণা…
– ঘুম এর সময় মস্তিষ্ক কাজ করে না (ঘুমিয়ে থাকে)
– নাক ডাকা চিন্তার বিষয় না
– শারীরিক সমস্যার সাথে ঘুম এর কোন সম্পর্ক নেই – ইত্যাদি ইত্যাদি ইত্যাদি।

বিভিন্ন সংস্কৃতি তে ঘুম নিয়ে আবার ভিন্ন ভিন্ন কিছু ধারণাও থাকে। যাই হোক, মনে রাখতে হবে সব সময় উপরোক্ত কথা গুলো সত্য না – ঘুম এর তত্ত্ব গুলো দেখলে আমরা বুঝতে পারবো ঘুম কেন এতো গুরুত্বপূর্ণ আমাদের জন্যে।

Theories of sleep – ইলেক্ট্রো-এন্সেফালোগ্রাম যন্ত্রটি আবিস্কার এর মাধ্যমে বিজ্ঞানিরা ঘুম এর প্রক্রিয়া, ধাপ
সমূহ, ঘুম এর ভিতরে মস্তিষ্কে কি কি ঘটে ইত্যাদি বিষয় আবিস্কার করেছেন কিন্তু আমরা কেনো আদৌ ঘুমাই, কি
দরকার এই ঘুমানোর তা নিয়ে অনেক ভাবতে হয়েছে বিজ্ঞানীদের। কয়েকটি জনপ্রিয় তত্ত্ব হচ্ছে –

Repair and Restorative theory – Oswald এর মতে ঘুম মস্তিষ্ক সহ আমাদের শরীর কে মেরামত করে থাকে। উনার মতে ঘুম এর বিভিন্ন ধাপ এ শরীরের বিভিন্ন অংশের মেরামত চলে। আমরা সারাদিন বিভিন্ন কাজে যে পরিমান শক্তি ক্ষয় করি, ঘুমের মাধ্যমে তা পুনরুদ্ধার হয়ে থাকে। সারাদিন শরীর ও মন স্বাস্থ্যকর ও পরিপূর্ণভাবে যেন কার্যসম্পাদন করতে পারে তার জন্যে “ঘুম” আমাদের গুরুত্বপূর্ণ শরীরবৃত্তীয় প্রক্রিয়া গুলোর জন্যে – যেমন তাপমাত্রা স্বাভাবিক করণ, হরমোনের ভারসাম্য রক্ষা, পরিপাকক্রিয়া ইত্যাদির জন্যে শক্তি যোগায়। যার ফলশ্রুতি তে আমরা সবাই সকাল থেকে রাত পর্যন্ত সকল প্রকার শারীরিক ও মানসিক কাজকর্ম করতে পারি। এমন কি গবেষণায় পাওয়া যায় যে ঘুম এর সময় আমাদের মস্তিষ্ক সব বর্জ্য পদার্থ নিষ্কাশন করে থাকে যা দিনের বেলায় বিভিন্ন কাজ সমপন্ন করার সময় মস্তিষ্কে জমা হয়। ধরা হয় এই বর্জ্য নিষ্কাশন এর ফলেই পুনরুদ্ধার প্রক্রিয়া টি সম্পন্ন হয়।

Evolutionary theory or Adaptive theory – এই তত্ত্ব অনুসারে বলা হয়, সব প্রাণীরই ঘুমানোর অভ্যাস গড়ে উঠেছে প্রকৃতির সাথে খাপ খাওয়ানোর মাধ্যমে এবং প্রাণী রা তখনই ঘুমায় যখন জেগে থাকা তার জন্যে বিপদজনক। এই তত্ত্ব অনুসারে, ঘুম আমাদের জন্যে একটি প্রতিরক্ষামূলক কাজ করে।

Information Consolidation theory – এই তত্ত্ব বলে মানুষ যখন ঘুমায় তখন তার মস্তিষ্কে সারাদিনের সংগ্রহকৃত সব তথ্য বিশ্লেষণ চলে। এবং এই তত্ত্ব আরও বলে যে ঘুম আমাদের পরবর্তী দিনে সব কাজ করার জন্যে তৈরি করে থাকে। গবেষকরা আরও বলেন, ঘুম আমাদের স্মৃতি গঠনে বিশেষ ভূমিকা রাখে। গবেষণায় দেখা গিয়েছে যারা নির্দিষ্ট পরিমান ঘুম থেকে বঞ্চিত হয়েছে তাদের মধ্যে বিভিন্ন বিষয় মনে করা এবং মনে রাখতে অসুবিধা হয়েছে।

যদিও কোন একটি তত্ত্বও “আমরা কেনো ঘুমাই?” এ প্রশ্নের উত্তর সরাসরিভাবে দেয় না, তবে ঘুম আমাদের যেসকল গুরুত্বপূর্ণ কার্যসম্পাদন করে তা দ্বারা আমরা যথেষ্ট ব্যাখ্যা পাই যে ঘুম কেন আমাদের জন্যে এতো প্রয়োজনীয় এবং এতো বোধগম্য হওয়ার কথা যে ঘুম এতো দরকার দেখেই আমরা ঘুমাই।

বিভিন্ন গবেষণায় পাওয়া তথ্য ও তত্ত্ব থেকে বোঝা যায় যে “ঘুম” আমাদের জীবনে অপশনাল কোন বিষয় নয় অথবা
বিলাসিতা নয়, বরং ঘুম আমাদের জীবন ধারনের একটি মৌলিক অংশ যা প্রতিদিন পরিমিত পরিমাণে থাকা আবশ্যক। “ঘুম” এর শারীরিক, মানসিক এবং আবেগীয় কার্যকারী উপাদান রয়েছে, তাই ঘুম এর গুনাগুণ ব্যহত হলে মানুষের জীবনে বিভিন্ন  দিকে এর প্রভাব পরে থাকে। একটি সুস্থ্য ও স্বাভাবিক জীবন যাপনের জন্যে পরিমিত খাওয়া, ঘুম ও শারীরিক শ্রম এর
কোনো বিকল্প নেই।

Psycure

Scroll to Top