বাচ্চাদের স্কুলে যাওয়ার প্রতি অনীহা পরিবারে নানা ধরনের ক্ষোভের সৃষ্টি করতে পারে। স্কুল পালানো
থেকে শুরু করে, বাড়ি থেকে বের না হতে চাওয়া, গাড়িতে বা স্কুলের বাসে যেতে অস্বীকার করা এমনকি বারবার
রাস্তায় নেমে আসাসহ বিভিন্ন কাজ বাচ্চারা করে থাকে। স্কুলে না যাওয়ার জন্য বাচ্চারা প্রতিনিয়ত ঘেনঘেন
করতে থাকে, যা বাচ্চা এবং বাবা-মার জন্য খুবই যন্ত্রণাদায়ক একটি ব্যাপার।

প্রতিবছর আনুমানিক ২-৫ শতাংশ বাচ্চা উদ্বিগ্নতা বা বিষণ্ণতার জন্য স্কুলে যেতে অনীহা দেখায়। যে
বাচ্চাদের মধ্যে সামান্য হলেও উদ্বিগ্নতা ও বিষণ্ণতা কাজ করে, দেখা যায় তারাই সপ্তাহে বা মাসে কোন
কোন দিন স্কুলে যেতে চায়না। পূর্বে একে “স্কুল ভীতি” হিসেবে আখ্যায়িত করা হত।

স্কুলে যেতে অনীহা একটি গুরুতর ইমোশনাল বা মেন্টাল সমস্যা। এটি বাচ্চা ও বাবা-মা উভয়ের জন্যই খুবই
স্ট্রেসফুল, সামাজিক, আবেগীয় এবং বাচ্চাদের একাডেমিক উন্নয়নের ক্ষেত্রে দীর্ঘমেয়াদি ও তাৎপর্যপূর্ণ
প্রভাব ফেলে। স্কুলে যাওয়ার প্রতি অনীহা যে মানসিক স্বাস্থ্যের সমস্যাজনিত কারণে হয়ে থাকে তাতে কোন
সন্দেহ নেই। এই সমস্যাগুলো দূর করার জন্য চিকিৎসা ও সহায়তা প্রকৃতপক্ষে খুবই জরুরী।

বাচ্চাকে নিয়মিত স্কুলে যেতে দেখে প্রাথমিকভাবে মনে হতে পারে যে, বাচ্চার মধ্যে স্কুলে যাওয়ার অনীহা
ধীরে ধীরে কমে গেছে। কিন্তু এরকমটা হওয়া অস্বাভাবিক নয় যে অনিচ্ছা সত্ত্বেও আপনার বাচ্চা কোন রকম
অশান্তি ছাড়াই নিয়মিত স্কুলে যাচ্ছে তার উদ্বিগ্নতা ও বিষণ্ণতার অনুভূতিগুলো চাপা দিয়ে এবং আপনার কাছ
থেকে লুকিয়ে। স্কুলের প্রতি অনীহা সময়ের সাথে সাথে বিকশিত হয় এবংনিম্নলিখিত বিষয়গুলির সাথেও এর
সম্পৃক্ততা রয়েছে:

Separation anxiety : এই এনজাইটি ডিসঅর্ডারটি বাচ্চাদের মধ্যেই প্রায়ই লক্ষ্য করা যায়। যে বাচ্চাদের
বাবা-মা আলাদা থাকে অর্থাৎ ব্রোকেন ফ্যামিলির বাচ্চাদের মধ্যে এই ধরণের এনজাইটি সবচেয়ে বেশি
লক্ষণীয়।
Social anxiety : এটিকে Performance anxiety- ও বলা যেতে পারে। এই ধরণের এনজাইটি যে বাচ্চাদের
মধ্যে রয়েছে তারা সহপাঠী বা বড়দের দ্বারা সমালোচিত হতে ভয় পায়। চারপাশের মানুষ তাকে নিয়ে কি ভাবছে
তা নিয়ে সর্বদা উদ্বিগ্ন থাকে।
Generalized anxiety : এই সমস্যায় যে সমস্ত বাচ্চারা ভুগছে তারা অতিরিক্ত উদ্বেগ অনুভব করে এবং
বিভিন্ন ঘটনা ও কাজকর্ম সম্পর্কে অহেতুক চিন্তা করে। এই উদ্বেগ সামাজিক, পেশাগত (স্কুল),
কর্মক্ষেত্রসহ অন্যান্য ক্ষেত্রে নানা সমস্যার সৃষ্টি করতে পারে।
Depression : শৈশব এবং বয়ঃসন্ধিকালীন কালে বিষণ্নতা সবচেয়ে বেশি লক্ষণীয় এবং তখন বিষণ্ণ মেজাজ,
জ্বালাময়তা, স্বাভাবিক ক্রিয়াকলাপে অংশগ্রহণে অনীহা, ঘুমের ব্যাঘাত, খাওয়ার অভ্যাস, সামাজিক
বিচ্ছিন্নতা, এবং আত্মঘাতী চিন্তাভাবনা বা পরিকল্পনাগুলি অন্তর্ভুক্ত থাকতে পারে।
স্কুলের প্রতি অনীহার লক্ষণ :

স্কুল পলায়ন এবং তা বাবা-মার কাছে গোপন রাখা, শারীরিক শক্তি প্রয়োগ করে স্কুল পালানো। তবে
স্টুডেন্টরা আরো অন্যান্য কৌশলী আচরণ করে থাকে। স্কুলের প্রতি অনীহার যে লক্ষণগুলো আমরা কখনো
কখনো অবহেলা করে থাকি সেগুলো হলো:
● মাথাব্যাথা, পেট ব্যথা, বুকে ব্যথা, পেশী যন্ত্রণা, ভয়াবহ অনুভূতি বা ক্লান্ত অনুভব করার মতো ঘন
ঘন শারীরিক অভিযোগ

● কারণ ছাড়াই নিয়মিত স্কুল নার্সিং গ্রহণ।

● পরীক্ষার দিন বা দিনগুলিতে অসুস্থতা অনুভব করা যখন স্টুডেন্ট কে মৌখিক রিপোর্ট উপস্থাপন
করতে হবে।

● বাড়ি যাওয়ার জন্য ঘন ঘন আবদার।
● সকালে বিছানা ছেড়ে উঠতে বিরক্ত বোধ করা।
● সহপাঠীদের সঙ্গে মিশতে বা সামাজিক ক্রিয়াকলাপে অংশগ্রহণ করতে অস্বীকার করা।

● ক্লাসের কাজ বাড়িতে সম্পূর্ণ করার ইচ্ছা।

চিকিৎসা পদ্ধতি :

১. মূল্যায়ন : চিকিৎসার প্রথম ধাপ হলো মানসিক মূল্যায়ন। স্কুলের প্রতি অনীহা সাধারণত অন্তর্নিহিত
উদ্বেগ ও বিষণ্ণতা থেকে সৃষ্টি হয়। এই সমস্যার মূল আসলে কোথায় তা বের করা সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। এই
ধাপে পরিবারের সদস্যদের পাশাপাশি শিক্ষকদের ইন্টার্ভিউ-ও নেয়া হয়ে থাকে।

২. কগনেটিভ বিহ্যাভিয়র থেরাপি : এটি একটি স্ট্রাকচার্ড থেরাপি যা বাচ্চাদের পরিবেশের সাথে মানিয়ে
নেওয়ার সমস্যাগুলো চিহ্নিত করতে এবং Adaptive Replacement Behavior-গুলো শিখতেও সাহায্য করে।
বাচ্চারা তাদের ভয়ের সাথে মোকাবেলা করতে শিখে এবং ভয়কে উপেক্ষা করে কিভাবে কাজ করতে হয় তা
আয়ত্ত করতে পারে।

৩. সিস্টেমিক ডিসেন্সিটাইজেশন: স্কুলে যাওয়ার প্রতি অনীহা আছে এমন বাচ্চাদের স্কুলে ফিরিয়ে নেওয়ার
জন্য বিভিন্ন গ্রেড পদ্ধতির ব্যবস্থা করা যেতে পারে। ধীরে ধীরে এটি অর্জনের জন্য স্কুলে যাওয়ার প্রতি
তাদের মধ্যে আগ্রহ সৃষ্টি হতে পারে।

৪. রিলাক্সেশন ট্রেইনিং: ডিপ ব্রেথিং, মাইন্ডফুলনেস ইত্যাদি কৌশল বাচ্চারা বাড়িতে অনুশীলন করতে পারে
এমনকি স্কুলেও করতে পারে। এতে তাদের মানসিক প্রশান্তি বাড়বে, মনোযোগী হতে পারবে এবং বিষন্নতাও
দূর হবে।

৫. পুনরায় ক্লাসে প্রবেশ করানোর পরিকল্পনা: চিকিৎসকদল বাচ্চাদের পুনরায় ক্লাসে ফিরিয়ে নিয়ে যেতে
নানা পরিকল্পনা এবং নানা কৌশল অবলম্বন করতে পারেন। যেমন: তাড়াতাড়ি ক্লাসে আসার জন্য,
শিক্ষকদের বিভিন্ন কাজে সাহায্য করার জন্য এবং সামনের ডেস্কে বসার জন্য তাদের পুরস্কৃত করা যেতে
পারে।
৬. নির্দিষ্ট রুটিন তৈরি : বাড়িতে একটি সুন্দর রুটিন মেনে চলার মাধ্যমে উদ্বিগ্ন বাচ্চারা কিছুটা উপকৃত হতে
পারে। অতিরিক্ত শিডিউল এড়িয়ে চলতে হবে, কারণ এটি উদ্বিগ্ন ও বিষন্ন বাচ্চাদের আরো বিষন্ন করে তোলে
এবং চাপ আরো বাড়িয়ে দেয়।
৭. ঘুম: সুস্থ্য ও স্বাভাবিক ঘুমের অভ্যাস করতে হবে এবং ছুটিরদিন গুলোতে ও সপ্তাহান্তেও ঘুমচক্র ঠিক
রাখতে হবে।
৮. সমবয়সী বন্ধুবান্ধব : অবসর সময় ও লাঞ্চ টাইমে সহপাঠীদের সাথে কথা বললে মানসিক চাপ ও বিষণ্ণতা
কমে যায়।
৯. সামাজিক দক্ষতা প্রশিক্ষণ : অনেক বাচ্চাদের বন্ধু তৈরি করতে অনেক বেগ পেতে হয়। তারা স্কলের
পরিবেশটা ঠিকমতো উপভোগ করতে পারেনা। সামাজিক দক্ষতা প্রশিক্ষণে সহপাঠীদের সাথে কিভাবে সম্পর্ক
তৈরি করতে হবে তা বাচ্চাদের শেখানো হয়।

স্কুলের প্রতি বাচ্চাদের অনীহা দূর করার জন্য কোন চটজলদি পদ্ধতি নেই। সময়ের সাথে সাথে ধীরেধীরে
বিভিন্ন কৌশল অবলম্বন করে বাচ্চাদের মধ্যে বাচ্চাদের মধ্যে স্কুলের প্রতি এই অনীহা দূর করতে হবে।
পাশাপাশি বাচ্চাদের নিঃশর্তভাবে ভালোবাসা ও সহায়তা প্রদান করাও খুবই গুরুত্বপূর্ণ।

Maria Ferdousi

Scroll to Top