বর্তমান সময়ে আমাদের জীবনের প্রায় প্রতিটি ক্ষেত্রেই প্রযুক্তির ছোঁয়া রয়েছে। প্রযুক্তির ব্যবহারে আমাদের জীবন যেমন সহজ হয়ে এসেছে, ঠিক তেমনি গোটা বিশ্ব আমাদের হাতের মুঠোয় চলে এসেছে। এ কথাগুলো এখন অবশ্য পুরনো মনে হয়। সারা দিনের অধিকাংশ সময় আমরা প্রযুক্তি সম্পর্কিত বিষয় গুলোর সাথে সংযুক্ত থাকি। আজকাল আমাদের সকল কার্যক্রমই কোনো না কোনো ভাবে প্রযুক্তির সাথে সম্পর্কিত বা প্রযুক্তির সাহায্যে সম্পন্ন করছি। আজকালকার যুবসমাজের মধ্যে অনেকেই নিজেকে “প্রযুক্তি প্রেমিক” হিসেবে আখ্যায়িত করতে বেশ স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করেন। আমাদের মাঝে অনেকেই নিত্য নতুন প্রযুক্তি ব্যবহার করতে ভালোবাসি। সেদিকে খেয়াল রেখেই প্রযুক্তি নির্মাতা প্রতিষ্ঠানগুলো তাদের তৈরি বিভিন্ন যন্ত্র বা প্রোডাক্টে প্রযুক্তির ছোঁয়া দিতে সর্বোচ্চ চেষ্টা করে যাচ্ছেন। তবে প্রযুক্তিনির্ভর এই সমাজে আমাদের পরিচিত অনেকেই রয়েছেন, যারা নিত্য নতুন প্রযুক্তির ব্যবহার করতে কিংবা প্রযুক্তিগত সেবা নিতে যথেষ্ট অনীহা প্রকাশ করেন । ব্যক্তিজীবনেও তারা প্রযুক্তিনির্ভর যেকোন বিষয় নিয়ে ভীতসন্ত্রস্থ থাকেন। মনোবিজ্ঞানের ভাষায় এই প্রযুক্তি ভীতি কে Technophobia বলা হয়।

 

যদিও আমরা সারাদিন প্রযুক্তির উপর নির্ভরশীল হয়ে থাকি, তারপরও আমাদের সবার মনেই কমবেশি প্রযুক্তি ভীতি আজ করে। প্রযুক্তি ভীতি নানা রকমের হতে পারে। কারো কারো ক্ষেত্রে এতটাই নগণ্য যে আমরা এটিকে কোন Phobia এর তালিকায় ফেলি না।  তবে কারো কারো ক্ষেত্রে এই বিষয়টি এতটাই গুরুতর যে তাদের এই ভীতিটি Technophobia  তে রূপান্তরিত হয়। চলুন তাহলে জেনে নেই, একজন মানুষের মনে কোন কোন বিষয়ের থেকে Technophobia এর সূত্রপাত ঘটতে পারে।

 

TECHNOPHOBIA এর সূত্রপাত:

★ নিরাপত্তা ভীতিঃ

নিরাপত্তা নিয়ে আমরা সবাই সতর্ক থাকি। আমরা সবসময় চেষ্টা করি নিজেদের ব্যাপারে সর্বোচ্চ নিরাপত্তা ব্যবস্থা গ্রহণ করতে। প্রযুক্তি ব্যবহারের ক্ষেত্রেও আমরা চেষ্টা করি আমাদের তথ্য ও প্রয়োজনীয় জিনিস গুলো যেন যথাযথ পন্থায় সবসময় নিরাপদ থাকে। প্রযুক্তিতে আমরা যেমন দিন উন্নতি করছে, ঠিক তেমনি প্রযুক্তি নির্ভর বিভিন্ন অপরাধও বৃদ্ধি পাচ্ছে। তার মধ্যে অন্যতম হচ্ছে হ্যাকিং। আমরা প্রায়ই সংবাদমাধ্যমগুলো থেকে জানতে পারি, বিভিন্ন সফটওয়্যার, অ্যাপ্লিকেশন,  সংস্থা কিংবা ব্যক্তিপর্যায়ের কেউ ব্যবহারকারীর তথ্য চুরি করেছে। আমরা যারা প্রযুক্তি ব্যবহার করি, তারা হ্যাকিং নিয়ে দুশ্চিন্তায় করি না এমন মানুষ খুঁজে পাওয়া বেশ দুষ্কর। যারা জীবনে কোনো পর্যায় কোনো প্রযুক্তি ব্যবহার করার ক্ষেত্রে হ্যাকিংয়ের শিকার হয়েছেন, তারা সাধারণত  Technophobia তে ভুগে থাকেন।

 

★ সাইবার বুলিংঃ

সাইবার বুলিং (Cyberbullying) শব্দটার সাথে বর্তমান সময়ে আমরা সবাই কম বেশি পরিচিত। নানান সময় আমাদের অনেকেই সাইবার বুলিং এর শিকার হয়েছি।  সাইবার বুলিং আমাদের মনস্তাত্ত্বিক বিষয়গুলোর উপর বেশ নেতিবাচক প্রভাব ফেলে। যার ফলে আমরা অনেকেই প্রযুক্তির ব্যবহার কিংবা তার উৎকর্ষতা আহরণের ক্ষেত্রে অনীহা প্রকাশ করি। এমনকি সাইবার বুলিং এ শিকার হয়ে অনেকে আত্মহত্যার পথও বেছে নিয়েছেন। দুঃখজনক হলেও সত্যি,  আত্মহত্যা কোনো সমাধান নয়, সাইবার আক্রমণের শিকার হলে অবশ্যই আইনত ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। সব সময় মনে শক্তি রাখতে হবে, অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করতে হবে।

 

★ অশালীন মন্তব্যঃ

নানান কাজে আমরা আমাদের সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমগুলোর ব্যবহার করে থাকি। মূলত সমাজের অন্যান্য মানুষদের সাথে নিজেদের মতবিনিময়, নিজেদের ভালোলাগা কিংবা খারাপ লাগার মুহূর্ত গুলো ভাগাভাগি করে নেওয়ার কাজেই আমরা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম গুলো বেশি ব্যবহার করি। তবে অনেক সময় বিকৃত মস্তিষ্কের অনেক মানুষ আমাদের বিভিন্ন পোস্ট ও ছবিতে কুরুচিপূর্ণ মন্তব্য করে থাকেন। মানসিক দৃঢ়তা এবং আবেগের উপর নিয়ন্ত্রণ করার দক্ষতার সাপেক্ষে এসকল কুরুচিপূর্ণ মন্তব্য আমাদের মানসিক স্বাস্থ্যের উপর বিভিন্ন মাত্রার প্রভাব ফেলে। অনেকে এসকল কুরুচিপূর্ণ মন্তব্য গ্রহণ করতে না পেরে বিভিন্ন ভুল সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে থাকেন। ধীরে ধীরে তাদের মাঝে Technophobia এর বিভিন্ন লক্ষণ দেখা দেয়।

 

ভুল করার বা নষ্ট করে ফেলার দুশ্চিন্তাঃ

বর্তমানে প্রযুক্তিনির্ভর বিভিন্ন যন্ত্র গুলো সাধারণত চড়া মূল্যের হয়ে থাকে। যার ফলে অনেকেই এ সকল যন্ত্র গুলো ব্যবহার করার ক্ষেত্রে দ্বীধাহীনতায় ভুগেন। এসকল যন্ত্রে কোনো ভুল করা কিংবা নষ্ট হয়ে যাওয়ার দুশ্চিন্তা থেকে অনেকের মাঝে প্রযুক্তির ব্যবহার সংক্রান্ত ভীতি কাজ করে।

 

প্রযুক্তিকে ভয় পাওয়ার কারণ:

নানান কারণে একজন মানুষ প্রযুক্তিকে ভয় পেত পারেন। চলুন এবার তাহলে জেনে নেই কোন বিষয়গুলোর কারণে সাধারণ মানুষ সাধারণত Technophobia তে ভুগেন।

 

★ প্রযুক্তি ব্যাপারে অজ্ঞতাঃ

আমরা সবাই কমবেশি প্রযুক্তি ব্যবহার করলেও প্রযুক্তির বিভিন্ন বিষয়ে আমাদের যথার্থ জ্ঞান নেই। অনেক সময় আমরা বিভিন্ন বিষয় না জেনেই প্রযুক্তি ব্যবহার করি। যার ফলে নানান সময় আমাদের নানা ক্ষতির সম্মুখীন হতে হয়। এসকল ক্ষতি একটা সময়ে এসে আমাদের জন্য Technophobia এর  কারণ হয়ে দাঁড়ায়।

 

★ বয়সের ব্যবধানঃ

বয়সে যারা ছোট অর্থাৎ নতুন প্রজন্ম প্রযুক্তির যেকোনো নতুন সংস্করণ ব্যবহার করার ক্ষেত্রে অধিক আগ্রহী হয়। বয়োবৃদ্ধ ও বয়স্কদের জন্য প্রযুক্তি ব্যবহার করা একটি প্রতিবন্ধকতা কিংবা চ্যালেঞ্জের মত।  অনেক সময় ভুল করার নানান দুশ্চিন্তা ও অতিরিক্ত চিন্তার কারনে বয়স্ক মানুষরা প্রযুক্তি ব্যবহার করার ক্ষেত্রে কিছুটা ভীতসন্ত্রস্থ থাকেন। অনেকের ক্ষেত্রে এটি Technophobia হিসেবেও পরিলক্ষিত হয়।

 

★ নারী পুরুষ তারতম্যঃ

অনেক সমাজেই লিঙ্গবৈষম্য এখনো বিদ্যমান। অনেক ক্ষেত্রেই নারীদের জন্য প্রযুক্তির বিভিন্ন দিক কিছুটা চ্যালেঞ্জিং হয়ে থাকে। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই পুরুষ ব্যবহারকারী থেকে নারী ব্যবহারকারীরা প্রযুক্তিগত যেকোনো বিষয়ে অধিক আক্রমণের শিকার হন। অনাকাঙ্ক্ষিত এসকল ঘটনা এবং দুঃখজনক অভিজ্ঞতা একজন নারী ব্যবহারকারীকে প্রযুক্তি ব্যবহার করার ক্ষেত্রে অনীহা সৃষ্টি করতে পারে। অনেক ক্ষেত্রেই দেখা যায় নারী ব্যবহারকারীরা প্রযুক্তি ব্যবহার করার ক্ষেত্রে ভীতসন্ত্রস্থ থাকেন। অনেকের মাঝে সময়ের পরিক্রমায় Technophobia এর লক্ষণগুলো পরিস্ফুটিত হয়। যদিও বর্তমানে নারীরা এসকল বিষয়ে অনেক সচেতন এবং প্রযুক্তি ব্যবহার তারা যথেষ্ট উদ্যমী ও আগ্রহী।

 

TECHNOPHOBIA এর লক্ষণ:

Technophobia আক্রান্ত একজন মানুষের মাঝে শারীরিক-মানসিক নানা রকম লক্ষণ দেখা দিতে পারে। যেমন ধরুন,

  • প্রযুক্তির ব্যবহারে অনীহা ,
  • গতানুগতিক ব্যবস্থায় সকল কিছু করতে চাওয়া ,
  • উন্নত প্রযুক্তি ব্যবহারে অনিচ্ছা ,
  • ব্যবহৃত বিভিন্ন প্রযুক্তি থেকে নতুন প্রযুক্তিতে উন্নত হওয়ার অনিচ্ছা ,
  • যতদূর সম্ভব প্রযুক্তিগত বিভিন্ন জিনিস এড়িয়ে চলা ,
  • প্রযুক্তিগত বিষয়গুলো শিক্ষার ব্যাপারে অনাগ্রহ প্রকাশ করা ,
  • দুশ্চিন্তার ফলে অতিরিক্ত ভুল করা,ইত্যাদি।

 

তাছাড়া বেশ কিছু শারীরিক লক্ষণও দেখা দিতে পারে,

  • হৃদস্পন্দনের গতি বেড়ে যাওয়া ,
  • অতিরিক্ত ঘামা ,
  • প্রযুক্তি ব্যবহারের সময় হাত পা কাপা,
  • অতিরিক্ত দুশ্চিন্তা করা ,
  • দুশ্চিন্তার ফলে চিৎকার ও কান্না করা ,
  • মাথা ব্যথা করা ,
  • অনিদ্রা, ইত্যাদি।

 

সমাধানের উপায়:

ইতিমধ্যে আমরা Technophobia সম্পর্কে একটি সামগ্রিক ধারণা পেয়েছি। বলুনতো তাহলে Technophobia থেকে পরিত্রাণের উপায় গুলো কি কি? চলুন এবার তাহলে Technophobia থেকে সুস্থ হওয়ার উপায়গুলো জেনে নেওয়া যাক।

 

  • যদি আপনি অনুভব করেন, আপনি Technophobia তে ভুগছেন, তাহলে অবশ্যই শুরুতে আপনার পরিবার এবং বন্ধুদের সাথে আলোচনা করুন,
  • পরিবার এবং বন্ধুদের থেকে কোন সমাধান না পেলে অবশ্যই চিকিৎসকের শরণাপন্ন হন,
  •  চিকিৎসকের পরামর্শ অনুযায়ী বিভিন্ন থেরাপি নিতে পারেন, যেমন
  • কগনিটিভ বিহেভিয়ার থেরাপি (Cognitive behavioral therapy )
  • ফিজিও ডাইনামিক থেরাপি ( Psychodynamic therapy)
  • এক্সপোজার থেরাপি  ( Exposure therapy)
  • ব্রিদিং এক্সারসাইজ ( Breathing Exercise) করা ,
  • মেডিটেশন (Meditation) বা ধ্যান করা ,
  • নিজেকে আত্মবিশ্বাস হিসেবে গড়ে তুলতে চেষ্টা করা ,
  • প্রযুক্তি সম্পর্কে জ্ঞান অর্জন করা ,
  • প্রযুক্তিগত যন্ত্র, এপ্লিকেশন ও সফটওয়্যারের গুরুত্বপূর্ণ নির্দেশনা গুলো ভালো মতন বুঝার চেষ্টা করা,
  • প্রযুক্তি সংক্রান্ত যে কোন ভুলকে ভয় না পেয়ে, সেগুলো শুধরে নেওয়া ,
  • সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম কিংবা ব্যক্তিগত পর্যায়ে প্রযুক্তিগত কোনো আক্রমণের শিকার হলে অবশ্যই আইনের ব্যবস্থা নেওয়া।

 

বর্তমান বিশ্বের প্রায় সবকিছুই এখন প্রযুক্তিনির্ভর। প্রযুক্তির সাথে আমরা যদি তাল মিলিয়ে না চলতে পারি তাহলে, আমরা বিশ্বের অন্যান্য মানুষের থেকে অনেক পিছিয়ে থাকবো। বর্তমানে শিক্ষাব্যবস্থা, ব্যবসা বাণিজ্য, লেনদেন ব্যাংকিং ব্যবস্থা, কর্মসংস্থান এমনকি বাসস্থানও প্রযুক্তির উপর নির্ভর হয়ে পড়েছে। আমরা যদি প্রযুক্তির সাথে খাপ খাওয়াতে না পারি তাহলে সমাজের টিকে থাকা আমাদের জন্য অত্যন্ত কষ্টকর হয়ে যাবে। তাই প্রযুক্তিকে ভয় না পেয়ে প্রযুক্তিগত শিক্ষা গ্রহণ করে, তা সঠিক উপায়ে ব্যবহার করতে হবে।

বুক ভোরে নিশ্বাস নিন, মন ভরে হাসুন। ভালো থাকুন নিজে, ভালো রাখুন নিজের আপন মানুষ ও পরিবেশকে। মনে রাখবেন, আমরা ভালো থাকলেই, ভালো থাকবে পৃথিবী।

Ali Mortuza

Scroll to Top