ডিপ্রেশন কিঃ
ডিপ্রেশন এক ধরনের মানসিক রোগ বা মনের রোগ। যা বিভিন্ন কারণে সৃষ্টি হতে পারেন। মন খারাপ থাকা আর ডিপ্রেশনে ভোগা এক বিষয় নয়। যেকোনো কারণে সাময়িক সময়ের জন্য মন খারাপ থাকতে পারে। তবে কেউ যদি ডিপ্রেশন বা বিষন্নতা ভোগেন তাহলে সেটা একটি মানসিক রোগও হতে পারে। ডিপ্রেশন একদিনে তৈরি হয় না। ধীরে ধীরে মানুষের মাঝে ডিপ্রেশনের বিভিন্ন দিক গুলো পরিলক্ষিত হয়। নানা কারণে ডিপ্রেশন হতে পারে
- অতিরিক্ত দুশ্চিন্তা,
- মানসিক আঘাত,
- অতিরিক্ত মানসিক দুঃখ-কষ্ট,
- জেনেটিক সমস্যা,
- দীর্ঘদিন ধরে রোগে আক্রান্ত অবস্থায় থাকা, ইত্যাদি উল্লেখযোগ্য।
WHO এর মতে, “অবসন্ন মন, শক্তি হীনতা এবং উৎসাহহীনতাকে ডিপ্রেশনের আওতায় ফেলা হয়”। তবে মনোবিজ্ঞানী অ্যারন বেক বলেন “নিজের, পরিবেশের এবং ভবিষ্যৎ সম্পর্কে নেতিবাচক ধারণার সম্মিলিত প্রকাশই হল ডিপ্রেশন।”
ডিপ্রেশন থেকে মুক্তি পাওয়ার উপায়ঃ
জীবনে কোনো না কোনো সময় আমরা সবাই কমবেশি বিষণ্নতা বা ডিপ্রেশনে ভুগেছি। কারো ক্ষেত্রে ডিপ্রেশন এর মাত্রা অনেক বেশি,আবার কারো ক্ষেত্রে অনেক নগণ্য। তবে আমাদের মাঝে অনেকর মাঝেই ডিপ্রেশনকে মন খারাপে বলে চালিয়ে দাওয়ার প্রবণতা রয়েছে। অর্থাৎ আমরা চেষ্টা করি আমাদের মানসিক রোগ গুলোকে পাশ কাটিয়ে চলেতে। কিন্তু দীর্ঘদিন ধরে ডিপ্রেশন ভুগতে থাকলে মানসিক নানান সমস্যার সাথে সাথে শারীরিক অনেক সমস্যাও দেখা দেয়। তাই চলুন বিষণ্নতা বা ডিপ্রেশন দূর করার ১০ টি উপায় এবার জেনে নেই।
০১/ ডিপ্রেশনে কারণ সম্পর্কে জানাঃ
সমস্যার সমাধান প্রাথমিক এবং অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ ধাপ হলো সমস্যা সম্পর্কে অবগত হওয়া। সেটি কোনো শারীরিক বা মানসিক সমস্যায় হোক কিংবা যে কোন পার্থিব সমস্যাই হোক না কেনো। কেননা সমস্যা নির্দিষ্ট করা না গেলে সমাধান পাওয়াটা বেশ দুষ্কর। তাই যখনই আপনার কাছে মনে হবে আপনি বিষন্নতা বা ডিপ্রেশন অনুভব করছেন তখনই চেষ্টা করুন ডিপ্রেশনের কারণ খুঁজে বের করতে। একবার আপনি ডিপ্রেশনে কারণটা খুঁজে বের করতে পারলে, সহজেই ডিপ্রেশন থেকে মুক্ত হওয়ার পদক্ষেপগুলো গ্রহণ করতে পারবেন। আর সঠিক কারণ বের করতে ব্যর্থ হলে, অনেক চেষ্টা করেও প্রকৃত সমস্যার সমাধান করা সম্ভব হবে না। তাই শুরুতেই সঠিকভাবে নিজের ডিপ্রেশন বা বিষন্নতা কারণটি নির্ণয় করুন।
০২/ আনন্দের উৎস খুঁজে বের করুনঃ
ব্যক্তি হিসেবে আমাদের প্রত্যেকেরই কিছু জিনিসের প্রতি একটু বাড়তি দুর্বলতা থাকে। আমাদের প্রত্যেকেরই এমন কিছু পছন্দের জিনিস আছে যেগুলো আমাদের সব সময় আনন্দ দিয়ে থাকে। নিজের অজান্তেই আমরা ঐ সকল বিষয় বা অনুভূতির মাঝে আনন্দ খুঁজে পাই। তাই ব্যক্তি হিসেবে আপনি কেমন এবং কোন বিষয়টি আপনাকে আনন্দ দিচ্ছে সেটি খুঁজে বের করুন। চেষ্টা করুন যখনই আপনি বিষন্নতা বা ডিপ্রেশনে ভুগছি তখন আপনার ভালোলাগার কাজগুলো বেশি বেশি করতে।
০৩/ নিজেকে অন্যের সাথে তুলনা করবেন নাঃ
আপনি খেয়াল করলে হয়তো দেখবেন আমাদের আশেপাশে প্রত্যেকটি মানুষই “পারফেক্ট” হতে চেষ্টা করে। আমরা সবাই এটা যদিও জানি পৃথিবীতে কেউই পারফেক্ট নয়, তবুও আমরা সর্বদা নিজেকে পারফেক্ট হিসেবে সবার সামনে তুলে ধরার চেষ্টা করি। হয়তো কোনো কোনো গুণের দিক থেকে অন্য একজন মানুষ আপনার থেকে অনেক ভালো। সে হয়তো বিশেষ কোনো গুণ বা দক্ষতার ধারা সবাইকে মুগ্ধ করছে। কিন্তু তারও অনেক ভুল-ত্রুটি এবং দুর্বলতা রয়েছে। হয়তো আপনার চোখে পড়ছে না কিংবা তিনি সবার সামনে নিজেকে সবসময় পার্ফেক্ট হিসেবে উপস্থাপন করছেন। তাই নিজের কোনো দুর্বলতা কিংবা ত্রুটি থাকলে সেটি নিয়ে অন্যের সাথে নিজেকে তুলনা করবেন না। তবে অবশ্যই চেষ্টা করবেন নিজের দুর্বলতাকে দ্রুত কাটিয়ে উঠতে।
০৪/ নেতিবাচক চিন্তা বন্ধ করুনঃ
আমাদের মস্তিস্ক সবসময় কোনো না কোনো চিন্তায় ব্যস্ত থাকে। হয়তো সেটাই ইতিবাচক চিন্তা না হয় নেতিবাচক অথবা একেবারেই অবান্তর চিন্তা চেতনা। নেতিবাচক চিন্তা আমাদের মাঝে মানসিক চাপের সৃষ্টি করে। দীর্ঘদিন এই মানসিক চাপের ফলে আমরা ধীরে ধীরে বিষন্নতায় বা ডিপ্রেশনে আক্রান্ত হয়ে পড়ি। তাই চেষ্টা করুন সবসময়ই পজেটিভ থাকতে অর্থাৎ ইতিবাচক চিন্তা গুলো বেশি করতে। নিজের চিন্তা ও কল্পনার উপর নিয়ন্ত্রণ রাখতে শিখুন।
০৫/ প্রিয়জনের সাথে সময় কাটানঃ
আমাদেরকে সবচেয়ে ভালো বুঝে আমাদের প্রিয়জনরা। তারা জানে কোন বিষয়টি আমাদেরকে আনন্দ দেয় এবং কোন বিষয়টি আমাদের বেদনা দেয়। তাই কখনো বিষন্নতা অনুভব হলে প্রিয়জনের সাথে সে বিষয়গুলো শেয়ার করতে পারেন। হয়তো আপনার অনেক সমস্যা আপনি নিজে বুঝতে পারছেন না কিংবা সমাধান বের করতে পারছেন না। আপনার প্রিয়জন হয়তো তার অতীতে কোনো অভিজ্ঞতা কিংবা ভালো কোন পরামর্শের মাধ্যমে আপনাকে সাহায্য করতে পারে। সপ্তাহে কিংবা সম্ভব হলে প্রতিদিন কিছু সময় প্রিয়জনের সাথে অতিবাহিত করুন।
০৬/ সবাইকে বলে বেড়াবেন নাঃ
আপনি বিষন্ন বা ডিপ্রেসড থাকলে কখনোই সবাইকে নিজের বিষন্নতা বা ডিপ্রেশনের কথা বলে বেড়াবেন না। কেউ কেউ হয়তো আপনাকে সাময়িক সময়ের জন্য সান্তনা দিতে পারে, তবে অধিকাংশ ক্ষেত্রেই ফল হিতের বিপরীত হওয়ার সম্ভাবনাই বেশি থাকে। অর্থাৎ আপনি হয়তো কাউকে নিজের বিষন্নতা বা ডিপ্রেশনের কথা বললেন, অপরজন হয়তো আপনার এই বিষন্নতা নিয়ে হাসিঠাট্টা শুরু করে দিল। পরিস্থিতি আরও খারাপ হলে, সেই ব্যক্তি হয়তো আপনার বিষণ্ণতার কথা সবাইকে বলে বেড়াতে শুরু করলো। ফলশ্রুতিতে আপনার বিষন্নতা কমা তো দূরেই থাক, আপনি আরো বেশি মানসিক চাপ এবং অশান্তিতে ভুগতে শুরু করবেন। যার ফলে আপনার বিষণ্নতা বা ডিপ্রেশন আরো বেড়ে যাবে। তাই চেষ্টা করুন নিজের একান্ত বিশ্বস্ত মানুষের কাছেই কেবল নিজের বিষণ্ণতার কথাগুলো বলতে।
০৭/ নিজেকে গুটিয়ে নিবেন নাঃ
যখনই কোন মানুষ বিষণ্ণতায় আক্রান্ত হন, অধিকাংশ ক্ষেত্রেই বেশিরভাগ তারা নিজেদেরকে গুটিয়ে নেন। নিজের স্বাভাবিক কার্যক্রম গুলোও এড়িয়ে চলার চেষ্টা করেন। এই মুহুর্তে আপনি হয়তো ভাবতে পারেন একা একা থাকলেই হয়তো সবকিছু ঠিক হয়ে যাবে। কিন্তু দেখা যায়, যখন একা থাকা শুরু করবেন আপনার মাঝে আরও বেশি একাকিত্ব ভাব চলে আসবে এবং আপনার বিষণ্নতা আরো বাড়তে থাকবে। তাই বিষন্নগ্রস্থ হলে বা ডিপ্রেশনে ভুগলে একা না থেকে বরং সবার সাথে মিলেমিশে থাকার চেষ্টা করুন। সবার সাথে কথা বলার চেষ্টা করুন। ভাবের আদান-প্রদান ঘটলে আপনার মন যেমন ভালো থাকবে ঠিক তেমনি ধীরে ধীরে আপনার ডিপ্রেশনও কেটে যাবে। অনেক সময় দেখা যায় কোনো অনুষ্ঠানে যাওয়ার ক্ষেত্রে আমার মন খারাপ কিংবা বিষন্নগ্রস্ততার দোহাই দিয়ে,সেই অনুষ্ঠানে অংশগ্রহন করি না। পরবর্তীতে,আমরা যখন সেই অনুষ্ঠানের বিভিন্ন ছবি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে বিভিন্ন বন্ধুর কাছে দেখতে পাই, তখন আরো বেশি বিষন্ন হয়ে পড়ি। তখন ভাবতে থাকি আমি আমি ছাড়া সবাই অনেক সুখী। সব সময় চেষ্টা করবেন ডিপ্রেশন আক্রান্ত হলে নিজেকে গুটিয়ে না রেখে, সবার সাথে মিলেমিশে চলতে।
০৮/ ধর্মীয় ও সমাজকল্যাণমূলক কাজ করুনঃ
ধর্মীয় ও বিভিন্ন সমাজকল্যাণমূলক কাজ মনস্তাত্ত্বিকভাবে শান্তি দিতে পারে। মানুষ যখন বিষণ্নতায় গ্রস্থ থাকে তখন তার আশার বিঘ্ন ঘটে। ফলে ধীরে ধীরে তার মাঝে আত্মবিশ্বাস এবং শান্তির অভাব দেখা দেয়। প্রার্থনা এবং ধর্মীয় কার্যক্রম মানুষের মাঝে নতুনভাবে আশা ও বিশ্বাসের সৃষ্টি করে। একইভাবে আপনি যখন সমাজকল্যাণমূলক কাজ করবেন, সুবিধাবঞ্চিতদের মুখে হাসি ফোটানোর চেষ্টা করবেন, তখন দেখবেন আপনি মানসিকভাবে অনেক শান্তি পাচ্ছেন।
০৯/ সুষম খাদ্য গ্রহণঃ
ডিপ্রেশনে থাকলে অনেকেরই খাবার-দাবারের প্রতি অরুচি ও অনীহা চলে আসে। যার ফলে শরীরে শক্তি বা ক্যালরির অভাব দেখা দেয়। এই অভাব মস্তিষ্কেও পরিলক্ষিত হয়। মস্তিষ্ক সঠিকভাবে কার্যক্রম চালাতে ব্যর্থ হয়। যার ফলে ধীরে ধীরে ডিপ্রেশন বা মানসিক অশান্তি বৃদ্ধি পেতে থাকে। তাই চেষ্টা করুন পর্যাপ্ত পরিমাণে সুষম খাবার গ্রহণ করতে। ওমেগা ৩ ফ্যাটি এসিড যুক্ত খাবার, অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট যুক্ত খাবার, প্রোটিন ও ভিটামিন যুক্ত খাবার শারীরিক এবং মানসিক বিকাশে সাহায্য করে।
১০/ চিকিৎসকের পরামর্শ গ্রহণ করুনঃ
একজন ব্যক্তিকে তিনি স্বয়ং সবচেয়ে ভালো চিনেন। তিনি নিজেই জানেন তার কোন বিষয়গুলি তার জন্য ভালো এবং খারাপ। তবে অনেক সময়ই আমরা নিজেদের বিভিন্ন সমস্যাকে নিজেরা সঠিকভাবে চিহ্নিত করতে পারিনা। যার কারণে আমরা সে সমস্যার পরিপ্রেক্ষিতে যথার্থ পদক্ষেপ গ্রহণ করতে পারিনা। তাই আপনি যদি মনে করেন বিষণ্নতা বা ডিপ্রেশন দিন দিন বেড়েই চলেছে, তাহল কালক্ষেপণ না করে দ্রুত চিকিৎসকের শরণাপন্ন হন। চিকিৎসকের পরামর্শ নিয়ে প্রয়োজনে ঔষধ ও থেরাপি গ্রহণ করুন।
মানুষ হিসাবে আমরা সকলেই কোনো না কোনো সময় বিষন্নতা বা ডিপ্রেশনে আক্রান্ত হয়েছি। অনেকের ক্ষেত্রে ডিপ্রেশন এতটাই নগ্ন যে, সেটিকে অগ্রাহ্য করা যায়। তবে কারও ক্ষেত্রে ডিপ্রেশন আত্মহননের কারণও হয়ে দাঁড়ায়। আমাদের মাঝে অনেকেই আছেন নিজের মানসিক স্বাস্থ্যজনিত সমস্যাগুলোকে আড়াল করে রাখে। তবে আড়াল করে রাখা মানসিক স্বাস্থ্যজনিত সমস্যাগুলোই পরবর্তীতে তার জন্য হুমকি হয়ে দাঁড়ায়। তাই নিজের যে কোন সমস্যাই গোপন করে না রেখে বরং সমস্যাটি সম্পর্কে জানুন এবং যত দ্রুত সম্ভব সমাধান করে ফেলা উচিত।
” Keep Yourself Busy If You Want To Avoid Depression. For Me, Inactivity Is The Enemy.”
– MATT LUCAS
হোক কলরব, বিষন্নতা সব দূর হয়ে যাক।